ফাইল ছবি
একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, একাত্তর টেলিভিশনের চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রূপা গত প্রায় পনেরো মাস ধরে কারাবন্দী। যে মামলায় তারা কারাবন্দী, তাদের আটক রাখার যে নির্দিষ্ট অভিযোগ, সেই অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ নেই বলে মনে করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।
তার মতে, সাংবাদিকেরা কোনো রাজনৈতিক দলের ও সরকারের সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটা অপরাধ নয়। হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ অভিযোগের পক্ষে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা এক কলামে ডেভিড বার্গম্যান এসব কথা বলেন। 'প্রমাণ ছাড়া এসব গ্রেপ্তার থামাতেই হবে' শিরোনামে তার ওই কলাম গত ৫ই জুন পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়। তার মতে, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার অভিযোগে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেকে দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ ছাড়া আটক রয়েছেন। এ ধরনের আটক ও জামিন না পাওয়ার ঘটনায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার লেখা ওই উপসম্পাদকীয়ের ভিত্তিতে সাজানো একটি প্রতিবেদন সুখবর ডটকমে ২৬শে জুন প্রকাশিত হয়।
ডেভিড বার্গম্যানের লেখা ওই কলাম চলতি সপ্তাহে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার আলোচনায় এসেছে। এর লিংক শেয়ার করে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেন মন্তব্য করছেন। বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা করছেন তারা। এসব বিবেচনায় সুখবর ডটকমের প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো—
একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, একাত্তর টেলিভিশনের চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রূপা যে মামলায় কারাবন্দী, তাদের আটক রাখার যে নির্দিষ্ট অভিযোগ, সেই অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ নেই বলে মনে করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।
তার মতে, ওই পাঁচ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ থাকলেও 'রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটাই অপরাধ নয়'।
ডেভিড বার্গম্যান বলেন, তাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা 'হয়তো সরাসরি সরকারের নয়, বরং রাজনৈতিক দল বা অন্য রাজনৈতিক চরিত্রের সহায়তায় দায়ের করা হয়েছে।' ডেভিড বার্গম্যান বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন।
তিনি বলেন, 'এটা ঠিক যে সাংবাদিক ও সম্পাদক শাকিল আহমেদ ও মোজাম্মেল বাবু ২৩শে (২০২৪ সালের) জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে এডিটরস গিল্ডের এক বৈঠকে আন্দোলনকারীদের নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন, এমন রেকর্ডও রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এ ধরনের বক্তব্যের কিছু অংশ ধাক্কা খাওয়ার মতো ছিল। তবে এসব বক্তব্যের কোনো অংশেই দেখা যায় না যে, তারা কেউ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন বা তা সমর্থন করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, তাদের আটক রাখার যে নির্দিষ্ট অভিযোগ, সেই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ এসব রেকর্ডে নেই।'
দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা এক কলামে ডেভিড বার্গম্যান এসব কথা বলেন। 'প্রমাণ ছাড়া এসব গ্রেপ্তার থামাতেই হবে' শিরোনামে তার ওই কলাম গত ৫ই জুন পত্রিকাটিতে প্রচারিত হয়।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ২৬শে জুলাই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে কয়েক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাকে আন্দোলন আরও কঠোর হাতে দমনে উৎসাহ দেন। অনেকে মনে করেন, তারা সাংবাদিক হিসেবে নন, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেদিন কাজ করেছিলেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারীরা যখন ছাত্রদের উপর গুলি চালাচ্ছিলেন জুলাই-আগস্টে, তখন একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে, স্থানীয় দু'জন সাংবাদিক শামীম ওসমানের সঙ্গে একটি মিছিলে ছিলেন। একজন সাংবাদিককে দুই হাতে দু'টি আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেও দেখা গেছে ওই ভিডিওতে।
বিভিন্ন জেলার এমন সাংবাদিক, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মামলা হওয়া কয়েক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে আর্থিক সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ আছে।
তবে বার্গম্যান মনে করেন, 'তাদের (কারাবন্দী) বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ অবশ্যই থাকতে পারে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারা এমন এক সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে সরকার বিরোধী দল দমন করেছে, নির্বাচনে জালিয়াতি করেছে, গুম করেছে, সংবাদমাধ্যমকে চুপ করিয়ে রেখেছে ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্যায়ভাবে মানুষকে আটক রেখেছে। তবু রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটাই অপরাধ নয়।'
প্রথম আলোতে প্রকাশিত বিশ্লেষণে ডেভিড বার্গম্যান বলেন, 'সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদ ৮ মাস, সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর ৭ মাস; লেখক ও নির্মূল কমিটির সাবেক নেতা শাহরিয়ার কবির ৮ মাস আর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত ৭ মাস ধরে কারাবন্দী। তাদের যে দীর্ঘমেয়াদি কারাবাসের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত গুরুতর সহিংস ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের অভিযোগে।'
তিনি লেখেন, 'তাদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট গোলাগুলির ঘটনায় হত্যা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে এ অভিযোগের পক্ষে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।'
তার মতে, 'তাদের গ্রেপ্তারের ভিত্তি হচ্ছে, ওই সময় আহত বা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনের দায়ের করা এফআইআর (প্রথম তথ্য প্রতিবেদন)। এই এফআইআরে অভিযোগ তোলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা বা ওই গোলাগুলির জন্য অর্থ জোগান দেওয়া কিংবা তা উসকে দেওয়ার কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।'
বার্গম্যান বলেন, 'এ-ও সত্য হতে পারে যে, এ আটকগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এফআইআরের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এগুলো হয়তো সরাসরি সরকারের নয়, বরং রাজনৈতিক দল বা অন্য রাজনৈতিক চরিত্রের সহায়তায় দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু এসব অপব্যবহারে হস্তক্ষেপ করে সেগুলো সংশোধন করতে সরকারের ব্যর্থতা অগ্রহণযোগ্য।'
তিনি লেখেন, 'অনেকেই আশা করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিস্তার লাভ করা যথেচ্ছ ও অন্যায় আটক রাখার সংস্কৃতি তাদের পতনের মধ্য দিয়ে এর অবসান ঘটবে। কিন্তু তার বদলে দেখা যাচ্ছে, নতুন সরকার মুখে সংস্কারের যতই বুলি আওড়াক, এ পুরোনো দমনমূলক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না কিংবা হয়তো পারছে না।'
খবরটি শেয়ার করুন