মঙ্গলবার, ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষেতের পাখি তাড়াবার গান আমাদের লোকসংস্কৃতির অংশ

সাহিত্য ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৯:১০ পূর্বাহ্ন, ১৯শে জানুয়ারী ২০২৫

#

প্রতীকী ছবি (সংগৃহীত)

রবিউল হক

পোক, পাখালি ও জীবজন্তু থেকে ফলমূল, শাক-শব্জি রক্ষা করার জন্য গৃহস্থরা জমিতে ভগ্গা দিয়ে থাকে। এটি মূলত খড় কুটার তৈরি নকল মানুষ বা কুশপুত্তলি। ভগ্গা দেয়া হচ্ছে উদ্দেশ্যপূর্ণ বাহ্যিক লোককৃতি। খুব সম্ভবত এটি শস্যসংক্রান্ত আদি প্রথা যা কৃষি সমাজে সুপরিচিত।

ভগ্গা শব্দটি সংস্কৃত ‘ভগ’ শব্দ থেকে সৃষ্ট। তবে বাংলা ভাষায় ফাঁকি বা প্রতারণা অর্থে ‘ভোগা’ শব্দের প্রয়োগ আছে। এটির উদ্ভব সম্ভবত হিন্দি ‘ভগল’ শব্দ থেকে। মুর্শিদাবাদে ‘ভোগা দেয়া’ বা ‘ভোগা কথা’ দ্বারা  ধোঁকা, মিছা ইত্যাদি অর্থে শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ড. এনামুল হকের মতে, চট্টগ্রাম জেলায় ভগ্গার আঞ্চলিক নাম ‘ধোক্কা’ বা ‘ধুক্কা’। ধোকা থেকে ধোক্কা হলে ভোগা থেকে ভগ্গা হওয়া খুব স্বাভাবিক। প্রহরীরূপে ভগ্গ বা কাকতাড়ুয়া কাকাদি পাখি ও শৃগলাদি জন্তুকে যে ভোগা বা ধোঁকা দেয়ার কাজ করে তাতে সন্দেহ নেই। ভোগা বা ভগ্গা শব্দটি ফরিদপুৃরে ‘অরগা’ এবং রংপুরে ‘আচাভুয়া’ নামে প্রচলিত।

এদিকে বাবুই পাখি ক্ষেতের প্রভূত অকল্যাণ সাধন করে ও পাকা ধান খেয়ে ফেলে। তাই নিম্নলিখিত গান গেয়ে বাবুইপাখিকে তাড়ানো হয়।

পক্ষীরে, আরে বাবুই রে

ক্ষেতের পাকনা ধান খাইলে।

উইড়া উইড়া ধান খায়,

পাইড়া পাইড়া রং চায়;

সবাই নালের আগায় বসারে।।

এক বাবুই ধলিয়া আর এক বাবুই কালিয়া

আরো পড়ুন : সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গাবিরোধী গান

আরেক বাবুইর কালে তিলক রে।।

কাল না ছেলেটায়,

ডাক দিয়া কইয়া যায়

বাদুর পড়্যাছে বাধার ক্ষেতেরে।।

একেলা মা পুতের বউ

সাত ক্ষেত রাখে গো

আরও জোগায় পান তেলের কড়ি।।

আরে রে বাবুই রে ক্ষেতের পাকনা ধান খাইলে।।

পাখি তাড়ানো গান ছাড়া পোকা-মাকড় তাড়ানো গান আছে। এ অনুষ্ঠানটি আলোডালো নামে বহুল পরিচিত। হিন্দু সমাজে কালী পূজার রাত্রে (কার্তিকের অসাবস্যা) যে দীপালি উৎসব হয়, এটি এরই অংশবিশেষ। গ্রামের বালক-যুবকেরা এক গাছি পাটকাঠি বেঁধে তার মাথায় আগুন ধরিয়ে রাস্তা, খোলা মাঠ-ঘাটে মশাল খেলে। একেই গ্রামে আলোডালো খেলা বলে। এ খেলায় হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। আগুনের খেলা বলেই সাধারণত বয়স্করা এতে অংশ নেয়। তারা মশাল ঘুরায় ও ছড়া বলে:

আলোরে ডালোরে

পোকা রে মাকড়- রে

দূর হ।।

খেলা শেষে পোড়া পাটগাছির পরিত্যক্ত অংশ শাক-সব্জি বা শস্যক্ষেতে পুঁতে দেয়া হয়। এর ফলে গাছ ও ফলমূলে পোকা ধরে না এমন লোকবিশ্বাস প্রচলিত। বগুড়া জেলায় এ অনুষ্ঠানটি ‘ভূত খেদানো’ নামে পরিচিত। অনেক স্থানে ‘উক’ বা ভূটিয়া অর্থৎ পাটকাঠির গোছা জ্বালিয়ে আপন আপন ধান ক্ষেতে যায় এবং ঘুরে ফিরে সেটি ক্ষেতের উপড়ে ঘুরায়। সে সময় তারা মুখে ছড়া বলে:

সোরহা।

সোগারে ধান টোনাসোনা,

মোর ধান পাকা সোনা

সোরহা।

গৃহস্থরা ঘরে যেভাবে সাঁজবাতি দেয় এটি ঠিক তেমনই। সাঁজবাতি না দিলে গৃহলক্ষ্মী ক্ষুণ্ন হন। অতএব তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ নিয়ম।

তথ্যকণিকা

১. সামীয়ূল ইসলাম, বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের শ্রেণীবিন্যাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭

২. ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোকসংস্কৃতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৪

৩. আবদুল হাফিজ, বাংলাদেশের লৌকিক ঐতিহ্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

৪.সিরাজুদ্দীন কাশিমপুরী, বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি।

এস/ আই.কে.জে                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                             

গান

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন