ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর একটি বাসা থেকে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৮) নামের এক নারী গণমাধ্যমকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমের কর্মী ছিলেন। গতকাল শনিবার (১৮ই অক্টোবর) সন্ধ্যার দিকে তার লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানা গেছে।
সহকর্মীদের অনেকে ধারণা করছেন, যৌন নির্যাতনের বিচার না পেয়ে মানসিক আঘাত ও ক্ষোভ থেকে স্বর্ণময়ী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তার সহকর্মী ও ঢাকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার জন্য দায়ী সাংবাদিক ও কবি আলতাফ শাহনেওয়াজকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরাও বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন।
রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাউল হক সুখবর ডটকমকে বলেন, ওই নারীর (স্বর্ণময়ী বিশ্বাস) পরিবারের লোকজন ঘরের দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। পুলিশ ওই হাসপাতাল থেকে গতকাল তার লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। ময়নাতদন্তের পর বলা যাবে, তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে। তার পরিবার এখনো থানায় কোনো অভিযোগ করেনি।
স্বর্ণময়ী অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর (আধেয় সম্পাদক) আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে যৌননিপীড়নের অভিযোগকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্যে জানা যায়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে শাস্তির পরিবর্তে চাকরিতে পুনর্বহাল করার কথা বলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তার মধ্যে এই নারী সংবাদকর্মীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে মহিলা পরিষদ। তাতে বলা হয়েছে, এমন সব ঘটনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
ঢাকা স্ট্রিম বড় বাজেটের নতুন গণমাধ্যম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের সংবাদ আধেয়তে পেশাদারত্ব ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছে। সংবাদ উপস্থাপনা থেকে অনেক কিছুতেই প্রতিষ্ঠানটি বেশ পেশাদার।
স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’ও। এই বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, শাহীন আনাম, শীপা হাফিজা, রেখা সাহা প্রমুখ।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আদালতের এক রায় অনুযায়ী দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত কমিটি থাকার কথা। অভিযোগের যথাযথ তদন্তে প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করার কথা তদন্ত কমিটি। এমন বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমটির কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, স্বর্ণময়ী ও অন্য নারী সাংবাদিকদের অভিযোগগুলোর যথাযথ তদন্ত করা; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এক্ষেত্রে এসব কিছুই করা হয়নি।
সহকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী আলতাফ শাহনেওয়াজের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অনলাইনটির সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন স্বর্ণময়ী। আলতাফ শাহনেওয়াজ শুধু স্বর্ণময়ী বিশ্বাসকে নন, একই প্রতিষ্ঠানের আরও একাধিক নারীকে হয়রানি করেছিলেন। লিখিত আবেদনপত্রে প্রমাণ হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলেন তার আরও ২১ জন সহকর্মী।
জানা গেছে, স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযুক্তকে শাস্তি না দিয়ে পুনর্বহাল করেন গণমাধ্যমটির প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী। পরে গলায় ফাঁস দেন তিনি।
ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ এ নিয়ে আজ রোববার (১৯শে অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, পুরো ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হবে।
বিকেল চারটার দিকে ঘটনার বিষয়ে ঢাকা স্ট্রিমের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক পি এম সজল আহমেদের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ১৩ই জুলাই অভিযোগ জমা পড়ে। পরে আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে সহকর্মীদের সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে তাকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। এসব সিদ্ধান্তে কর্মীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ওই নারীর নাম উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, তার মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিন মাস আগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আলতাফ শাহনেওয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ পাঠিয়েও কোনো ফিরতি বার্তা মেলেনি। উল্লেখ্য, তিনি ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা বিভাগের প্রধান। এর আগে তিনি দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। কবি ও সাংবাদিক হিসেবে তার বেশ পরিচয়-খ্যাতি আছে।
স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের বাড়ি ঝিনাইদহে। তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। এক বছর আগে ঢাকা স্ট্রিমে যোগ তিনি। স্বর্ণময়ী তার বাবা সত্যজিৎ বিশ্বাস, মা রোমা রানি বিশ্বাস ও ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন।
উল্লেখ্য, দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী নিপীড়ন বিশেষ করে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নারীরা এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অফিসগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের হার কম হওয়ায় এই নিপীড়নের মাত্রা বেশি। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই নিপীড়ন ও নির্যাতন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটন অনেক সহজ হয়েছে।
২০২০ সালে মহিলা পরিষদ, নারী উন্নয়ন ফোরাম এবং অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে জানা যায় দেশের কর্মক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ নারী কর্মী শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ নারীর কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই জরিপে আরও উঠে আসে প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী তাদের সহকর্মী বা সুপারভাইজারের কাছ থেকে অশ্লীল মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণের শিকার হন।
খবরটি শেয়ার করুন