অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের মার্কিনি প্রচেষ্টা কি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে? অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি জোশ পলের পদত্যাগ এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। লিঙ্কডইনে পোস্ট করা তার পদত্যাগ সংক্রান্ত একটি চিঠিতে জোশ পল হামাসের হামলাকে নিন্দা করার পাশাপাশি লিখেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল যে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তা কেবল আরও এবং বৃহত্তর দুর্ভোগের দিকে নিয়ে যাবে। পল তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন যে এ অঞ্চলের অনেক দেশের সাথে কাজ করার সময়, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাগুলি সম্পর্কে তিনি বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। ইসরায়েলি কাউন্টারটেরোরিজম এবং নাগরিক অধিকারের উপর তিনি তার মাস্টার্সের থিসিস লিখেছেন, রামাল্লায় মার্কিন নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করাকালীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-এর সাথে সময় কাটিয়েছেন এবং সংঘাতে জড়িত উভয় পক্ষের সাথে তার “গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক” আছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই প্রবীণ আধিকারিক ইসরায়েলে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে "বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব" হিসেবে বর্ণনা করে পদত্যাগ করেছেন। কারণ হামাসের রকেট ও ইসরায়েলের বোমা হামলায় মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের কংগ্রেসনাল এবং পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক জোশ পল, লিঙ্কডইন-এ পোস্ট করা চিঠিতে আরও বলেছেন যে (মার্কিন) সরকার ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা ছিল "তাড়াতাড়ি", ‘অদূরদর্শী, ধ্বংসাত্মক, অন্যায্য এবং আমেরিকা প্রকাশ্যে যে মূল্যবোধগুলিকে সমর্থন করে তার সাথে সাংঘর্ষিক!’ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অন্দর মহলের এক কর্মকর্তার এই অনুভূতির ভিত্তিতে বলা যায়, “অস্ত্রের ভাষায়” মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি স্থাপন প্রচেষ্টার ব্যর্থতা জো বাইডেন প্রশাসন নিজেরাই ডেকে আনছেন!
গত সপ্তাহ অর্থাৎ ২০২৩ এর ১৮ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত, মার্কিন-সংশ্লিষ্ট কূটনীতিক এবং সামরিক পরিমণ্ডলের বাইরে জোশ পল খুব কমই জানাশোনা ছিলেন। ১৯ অক্টোবর মঙ্গলবার তিনি পদত্যাগ করেন। ১৮ অক্টোবর সোমবার হাফপোস্ট-এর আকবর শহীদ আহমেদ-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে জোশ পল সর্বপ্রথম তার পদত্যাগ এবং এর কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলেন। এর আগে থেকেই পল তার সহকর্মীদের সাথে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিঙ্কডইনে তড়িঘড়ি করে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রেরণ সম্পর্কে তার ভিন্ন মতের কথা প্রকাশ করছিলেন। যা হোক, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে পদত্যাগ করার কারণে হঠাৎ করেই তিনি বিশেষতঃ ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের নীতির ব্যাপারে কৌতূহলী সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকদের আলোচনা-পর্যালোচনার পাদপ্রদীপে চলে এসেছেন। পল স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোকে "পার্টনার এবং মিত্রদের কাছে অস্ত্র সরবরাহের এবং প্রভিশনের জন্য সর্বাধিক দায়ী মার্কিন সরকারের সংস্থা" হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
এরই মধ্যে, পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত জোশ পল-এর একটি লেখার বাংলা অনুবাদ বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা দেয়ার আগেই (যেমনটি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি) জোশ পল প্রথমে লিঙ্কডইনে, তারপরে সর্বপ্রথম হাফপোস্ট-এর আকবর শহীদ আহমেদ-এর সাথে সাক্ষাৎকারে, এরপর একে একে পলিটিকো-এর নাহাল তুসির সাথে আলাপকালে, পিবিএস-এর নিক শিফরিন-এর সাথে সাক্ষাৎকারে, এবং এনপিআর-এর র্যাচেল ট্রেইসম্যানের সাথে সাক্ষাৎকারে পদত্যাগের ব্যাপারে জোশ পল তার নিজের ব্যাখ্যা তথা কারণগুলো ব্যক্ত করেছেন। এইসব সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত জন ইসমে-র প্রতিবেদন, সিএনএন-এর শরীফ পেগেট-এর প্রতিবেদন, দ্যা গার্ডিয়ান-এর অ্যাডাম গ্যাব্বাট-এর প্রতিবেদনে জোশ পল-এর পদত্যাগ বেশ জোরেশোরে আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ভিসা নীতি, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যে কোনও বিষয়ে যথারীতি আমেরিকার খবরদারি এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ‘পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ’ প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ‘টক্ শো’, অনলাইন পত্রিকা এবং ছাপানো পত্রিকার ‘কলামগুলোকে’ ভারী করে তুলছে! এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বলা বাহুল্য, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধকেন্দ্রিক জনমতের বিভক্তির মধ্যে কতটুকু ‘রাজনৈতিক উপাদান’ এবং কতটুকু ‘ধর্মীয় উপাদান’ আছে তা এখন পর্যন্ত পরিমাপ না হওয়া সত্ত্বেও, এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে ‘সরবতা’ এবং ‘নীরবতা’ উভয়ই লক্ষ করা যাচ্ছে!
ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সোচ্চার। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আওয়ামী লীগের এই সমর্থন এবারের হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ চলার সময়েও বজায় আছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশ ও পাকিস্তানের সমর্থন পাওয়া তথা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানকে “ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানীকরণ” করা সত্ত্বেও এবারের হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিন এবং আল্ আকসা মসজিদের ব্যাপারে বিএনপি একেবারে চুপ! বিএনপি ফিলিস্তিন এবং আল্ আকসা মসজিদে মুসলমানদের অধিকারের ব্যাপারে ‘নীরব’ থাকলেও, পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ জনমত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং আল্ আকসা মসজিদে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ‘সরব’। অতএব, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বাংলাদেশের জনমত ভিত্তিক সমর্থনের হিসাব যদি করা হয় তাহলে দেখা যাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ জনমতের সমর্থনপুষ্ট হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আর এর বিপরীতে বিএনপি, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের পক্ষ সমর্থন না করার কারণে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ জনমতের ভাগীদার হতে পারে!
তাই বলা যায়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ সচেতন মহল জোশ পল এর পদত্যাগ-এর ব্যাপারে আগ্রহ পোষণ করেন। ‘অবতার’রূপী আমেরিকার সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় বিএনপি ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে, অর্থাৎ বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে! জোশ পল-এর পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্টের লেখা বাংলা অনুবাদ করে বাংলাদেশের যে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে সেই সংবাদপত্রটি সবচেয়ে জনপ্রিয়! পাঠকপ্রিয়তা ছাড়া তারা কোনও বিষয় ছাপে না! পাঠকপ্রিয়তার ব্যারোমিটার লক্ষ্য করে এই সংবাদপত্রটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে “সমর্থক-তথ্য-উপাত্ত ছাড়া” “অসাম্প্রদায়িক” হিসাবে আখ্যায়িত করে লেখা কলামও প্রকাশ করে! আবার এর বিপরীতে এবং এর প্রতিবাদস্বরূপ সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে লেখা কলাম এই পত্রিকাটি প্রকাশ করে না! অতএব এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, শুধু বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয়তা লাভের উদ্দেশ্যেই এই সংবাদপত্রটি মার্কিন প্রশাসনের একেবারে অন্দরমহলের খবর সম্বলিত জোশ পলের লেখার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে!
লিঙ্কডইনে পোস্ট করা দুই পৃষ্ঠার এই চিঠিতে, জোশ পল বলেছেন যে তিনি এক দশক আগে যোগদানের সময় নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি ততক্ষণ এই দায়িত্বে থাকবেন, তার ভাষায়, ‘যতক্ষণ না আমি অনুভব করি যে আমি যে ক্ষতি করতে পারি তা আমি যা ভালো করতে পারি তার চেয়ে বেশি হতে পারে।’ ৪৫ বছর বয়সী জোশ পল একজন আমেরিকান যিনি লন্ডনে বেড়ে উঠেছেন এবং একটি স্বতন্ত্র ব্রিটিশ উচ্চারণে কথা বলেন, রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরো থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে বেসামরিক কর্মচারী হিসাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টে ১১ বছরেরও বেশি সময় চাকরি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অনেক ঝামেলাপূর্ণ সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাঠানো তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন তার এইসব কাজ যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করছে। জোশ পল তথা স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের “ভিন্ন” বিশ্বাস থাকাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাট মিলার প্রশংসা করেছেন। ম্যাট মিলার আরও বলেছেন, “আমরা বুঝতে পারি, আমরা আশা করি, আমরা উপলব্ধি করি যে এই বিভাগে কর্মরত বিভিন্ন ব্যক্তিদের আলাদা রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে, ভিন্ন ব্যক্তিগত বিশ্বাস আছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে ভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে।”
আমেরিকান একাডেমি অব ডিপ্লোমেসির প্রেসিডেন্ট এবং আফগানিস্তানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রোনাল্ড নিউম্যান বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সাথে একমত না হলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা দুটি জিনিস করতে পারেন : পদত্যাগ করা অথবা অন্য চাকরিতে বদলি হতে চাইতে পারেন। “প্রায়শই লোকদের ঠিক সেই বিষয়েই মোকাবিলা করতে হয় যা জোশ পল তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, যা তারা একটি অবস্থানে থেকে যে ভালো তারা করতে পারেন তা করা অথবা যে বিষয়ে তারা একমত নয় তার বিরুদ্ধে নীতিগত লড়াইয়ে থাকার মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখা।” কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে জোশ পল এর পদত্যাগ জো বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নীতির উপর কোনও প্রভাব বিস্তার করবে না। তবে, হামাসের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলে বাইডেনের অস্ত্র সরবরাহ, রকেট ও বোমা হামলার কারণে মৃত্যুর মিছিল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। যে ব্যর্থতাকে জোশ পল মার্কিন প্রশাসনের “বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের মতো, তাহলে বাংলাদেশেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তথা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যে দৌঁড়ঝাপ দিচ্ছেন তা কি ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হতে যাচ্ছে?
*প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।