শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণ রেখে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা বাবা, কিডনি বিক্রি করে পরিশোধ করতে চান ছেলে!

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১০:০৩ অপরাহ্ন, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

পিতার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে নিজের একটি কিডনি স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র দিনমজুর ছেলে। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল গ্রামের বাসিন্দা মো. নাসির তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে এই পোস্টটি করেন।

ঘটনার বিস্তারিত জানতে নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, আমার দিনমজুর পিতা মো. নুরুল ইসলাম ছিলেন রনাঙ্গন কাঁপানো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার গেজেট নাম্বার-৩৪৯৩। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক পদক পেয়েছেন তিনি। তিনি সোনালী ব্যাংক গৌরনদী শাখা থেকে সরকারি ভাতাও উত্তোলন করতেন।

মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে আমার দাদার নাম ভুলবসত আমজেদ আলী হাওলাদারের পরিবর্তে মৃত মোসলেম উদ্দিন মুন্সী লেখা হয়। ২০১৮ সালে ভুল সংশোধনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে আমার পিতা আবেদন করেন। তার জীবদ্দশায় ভুল সংশোধন করে যেতে পারেননি। ২০২০ সালে তিনি মারা যান। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

পিতা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর সমাজসেবা অফিসে এমআইএস সংশোধন করতে গিয়ে দেখি আমার পিতার ছবির জায়গায় অন্য একজনের ছবি। এতে আমার সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ছবির ওই ব্যক্তি মুলাদী উপজেলার মধ্য গাছুয়া গ্রামের বাসিন্দা। সে গৌরনদীর সরিকল নিজাম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক। তার নাম নুরুল ইসলাম এবং তার বাবার নাম মৃত মোসলে উদ্দিন। এরপর এমআইএস ফরম সংশোধনের জন্য ২০২১ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আমি লিখিত আবেদন করি।

আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি নিয়ে শুনানির জন্য আমাকে এবং মুলাদীর নুরুল ইসলামকে তার অফিস কক্ষে হাজির হতে বলেন। পরবর্তীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস।

ওই শুনানিতে মুলাদীর নুরুল ইসলাম ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হন। একপর্যায়ে সে (মুলাদীর নুরুল ইসলাম) ইউএনও’র কাছে মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পান। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু মুলাদীর ওই নুরুল ইসলাম প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে স্থানীয় কিছু অসৎ মুক্তিযোদ্ধার যোগসাজশে ফের পুনঃতদন্তের জন্য আবেদন করেন। সম্প্রতি উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধার ছেলে নাসির অভিযোগ করে গণমাধ্যমকে বলেন, মুলাদীর নুরুল ইসলামের বাড়ি মুলাদী উপজেলায়। নিয়ম অনুযায়ী, তার গেজেট হবে মুলাদীতে। কিন্তু ওই নুরুল ইসলাম মুলাদীতে গেজেট না করে আমার পিতার নামের সঙ্গে তার নামের মিল থাকায় বিভিন্ন জালজালিয়াতির মাধ্যমে আমার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা পিতার গেজেট দিয়ে সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আসছে।

তিনি আরও বলেন, আমার পিতা মৃত্যুর আগে সোনালী ব্যাংক গৌরনদী শাখা থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ উত্তোল করেন। ব্যাংক দুই লাখ তেতাল্লিশ হাজার টাকা আমার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা পিতার কাছে পাওনা রয়েছে। ওই ঋণের জামিনদার ছিলাম আমি। সে হিসেবে ব্যাংক থেকে আমার নামে নোটিশ দিয়েছে। সময়মতো টাকা দিতে না পারলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। মুলাদীর ওই নুরুল ইসলামের কারণে আমার পিতার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তিনবছর যাবত বন্ধ। এ নিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। বর্তমানে স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে মানববেতর জীবনযাপন করছি। আমার এমন কোনো সম্পদ নেই যা দিয়ে পিতার ঋণ পরিশাধ করব। তাই স্বেচ্ছায় একটি কিডনি বিক্রির জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন, আবুল কাসেম ও মতিউর রহমানসহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সরিকলের মৃত নুরুল ইসলাম একজন প্রকৃত ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার মৃত্যুর পর মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম সরিকলের মৃত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের গেজেট ব্যবহার করে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আসছে। এজন্য দীর্ঘদিন যাবৎ ভাতা স্থগিত রয়েছে। ফলে মৃত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের ছেলে নাসির মানববেতর জীবনযাপন করছে। মৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার যাতে ভাতা উত্তোলন করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান তারা।

সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, নাসিরের পিতা নুরুল ইসলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ থাকায় অসহায় ওই পরিবারটি চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছেন। কখনো শুনিনি নিজাম উদ্দিন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক মুলাদীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন তিনি কীভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন তা জানা নেই।

তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক ও মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে গেজেটে ৩৪৯৩ নম্বরটি তার বলে দাবি করেছেন।

গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু আবদুল্লাহ খান গণমাধ্যমকে জানান, উভয়পক্ষের শুনানি শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। নাসিরকে যাতে ব্যাংক থেকে চাপ প্রয়োগ করা না হয় এজন্য ম্যানেজারকে বলে দেওয়া হয়েছে।

এইচআ/ আই.কে.জে/ 


মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কিডনি বিক্রি ঋণ পরিশোধ

খবরটি শেয়ার করুন