ফাইল ছবি
বৈদেশিক মুদ্রায় স্বল্প-মেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বের আর্থিক বাজারে উচ্চ সুদহারের বর্তমান প্রবণতার কথা উল্লেখ করে ব্যাংকারদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (১লা ফেব্রুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৈদেশিক ঋণের বার্ষিক সব সুদহার সীমা সংশোধন করা হয়েছে। এখন থেকে সোফর (দ্য সেকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট), ইউরিবর (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট), ইত্যাদি সুদহারের সাথে ৪ শতাংশ পর্যন্ত মার্কআপ বা মার্জিন যুক্ত করে গ্রাহককে ঋণ দিতে পারবে। যা আগে ৩.৫ শতাংশ যুক্ত হতো।
মার্কআপ বাড়ানোর ফলে বাণিজ্য অর্থায়নে দেশের আমদানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের খরচ কিছুটা বাড়বে। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, এর ফলে স্থানীয় ব্যাংক বিদেশ থেকে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিয়ে তহবিল আনতে পারবে, গ্রাহকদের বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে পারবে, এবং এতে পড়তির দিকে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও চাঙ্গা হবে।
ব্যাংকগুলো এখন থেকে সোফর এর সাথে আরও ৪ শতাংশ সুদ যোগ করে মোট ৯.৩ শতাংশ হারে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারবে। ছয় মাসের গড় সোফর রেট অনুযায়ী এই হিসাব করা হয়েছে, যা বৃহস্পতিবার ছিল ৫.৩৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারের স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ নির্ধারণের বেঞ্চমার্ক হচ্ছে সোফর সুদহার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের পরিচালক সারোয়ার হোসেন বলেন, বাণিজ্য সহায়ক এই নীতির ফলে এখন দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। কারণ বিদেশ থেকে এখন আরও বেশি ফান্ড নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। একারণেই সুদহার বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ঋণ খেলাপিদের ধরা হবে’
আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বৃদ্ধি এবং ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাগুলোর বাংলাদেশের ঋণঝুঁকি অবনমনের কারণে বিদেশি ঋণদাতারা ঋণ দিতে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। এই অবস্থায়, ব্যাংকাররা বৈদেশিক মুদ্রায় স্বল্পমেয়াদী বাণিজ্যিক ঋণ দেওয়ার জন্য মার্কআপ ১০০ থেকে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর দাবি করেছিলেন।
তারা বলেন, বাংলাদেশের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পড়তির দিকে থাকায় এবং মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি ঋণদাতারা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাণিজ্য অর্থায়ন হিসাবে বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার পায়, যা অফশোর ফাইন্যান্স নামেও পরিচিত।
তারা জানান, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। আগে লোকসান হলেও এখন ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকে ঋণ দিয়ে কিছুটা লাভ হবে।
২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে রিজার্ভ
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস (মোট) রিজার্ভ এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮৩ মিলিয়ন ডলার কমে বৃহস্পতিবার ১৯.৯৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আইএমএফ নির্দেশিত বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে এই হিসাব করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত ডলার বিক্রির কারণেই ক্রমাগত রিজার্ভ কমছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, একদিকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে, দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ (ইনফ্লো) কমে গেছে। একারণেই রিজার্ভ কমছে। বাংলাদেশে ডলার সমস্যার প্রধান কারণ ইনফ্লো কমে যাওয়া। যতদিন ডলার ইনফ্লো না বাড়বে, ততোদিন সংকট কাটবে না।
বাংলাদেশ থেকে ডলারের বহির্গমন (আউট ফ্লো) কমাতে সরকার আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এভাবে কতদিন চলবে! দেশের প্রয়োজনেই একটা সময় এই সীমা তুলে দিতে হবে। কারণ বিদেশে থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি না করলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। কমে যাবে কর্মসংস্থান। তার সাথে কমে যাবে জাতীয় প্রবৃদ্ধি। তাই এসব বিধিনিষেধ একটা সময় উঠিয়ে দিতে হবে।
রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধান করতে হলে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
অন্য পদ্ধতিও চিন্তা করতে হবে। যেমন রপ্তানি বহুমুখীকরণ। আমাদের দেশের রপ্তানি খাত শুধু একটি পণ্যের (তৈরি পোশাক) ওপর নির্ভরশীল। তৈরি পোশাকের মতো অন্যান্য খাতেও প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরেও রপ্তানি বাজার তৈরি করা খুবই জরুরি বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক গভর্নর।
সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, ডলার সংকট নিরসনের আরেকটি উপায় হলো– বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা। বাজার নিয়ন্ত্রণে ক্রলিং পেগ দিয়ে লাভ নাও হতে পারে। দেশকে বিনিয়োগ-বান্ধব করতে পারলে এমনিতেই ডলার ইনফ্লো বাড়বে।
এসকে/
খবরটি শেয়ার করুন