সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আত্মগোপনে আলোচিত মতিউরের স্ত্রী

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১০:১৫ পূর্বাহ্ন, ২৪শে জুন ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

মুশফিকুর রহমান (ইফাত) নামের এক তরুণের ১২ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আলোচনায় আসেন ওই তরুণের বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান। রোববার (২৩শে জুন) তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। এসবের জেরে এখন আলোচনায় মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরার উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী। 

গত কয়েকদিন ধরে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, ফোন কলেও পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি তিনি এখন কোথায় আছেন, তাও কেউ বলতে পারছে না। 

উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলছেন, ঈদের দুই দিন আগে সর্বশেষ অফিস করেছেন লায়লা কানিজ লাকী। ঈদের ছুটি শেষে এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও কার্যালয়ে আসেননি তিনি। তাদের ধারণা, তিনি ছাগলকাণ্ডে বেশ বিব্রত। সাংবাদিকরাও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেতে তার কার্যালয়ে এসে খোঁজাখুঁজি করছেন।

আরো পড়ুন: আলোচিত মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকের তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম

রায়পুরার ইউএনও ইকবাল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ঈদের পর উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ তার কার্যালয়ে আসেননি। রোববার সকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাতেও তিনি অংশ নেননি। ব্যক্তিগত কারণে তিনি সোমবার আসতে পারবেন না জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু কবে আসবেন তা বলেননি, কোনো ছুটিও নেননি।

জানা গেছে, লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমির সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলেন। সেখানেই ২০১৮ সালে পরিচয় হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদের। একপর্যায়ে লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে আমন্ত্রণ জানান তিনি। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছাদেক মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হন। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গণমাধ্যমকে বলছেন, কেবল অবৈধ টাকার জোরেই লায়লা কানিজ লাকী স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর পৃষ্ঠপোষকতায় রায়পুরার রাজনীতিতে সুযোগ পেয়েছেন। এসব টাকা সবই তার স্বামী আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জনের টাকা। শিক্ষকতার আয়ে তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়। তাকে জোর করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারা এখন কোনঠাসা। তার এই অবৈধ টাকার তৎপরতা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকেও বিভক্ত করেছে। অবস্থা এখন এমন যে, সংসদ সদস্য এবং তিনি একটি পক্ষ আর সব আওয়ামী লীগ নেতা আরেক পক্ষ। সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় নরসিংদীর সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন তিনি।

অধ্যাপিকা থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লা কানিজের নামে প্রচুর সম্পদ। তার নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, তার বাৎসরিক আয় কৃষিখাত থেকে ১৮ লাখ, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।


তার কৃষিজমির পরিমান ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ। লায়লা কানিজ লাকির ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, তিনি তার মোট সম্পত্তির মাত্র অর্ধেকেরও কম দেখিয়েছেন হলফনামায়। 

মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ লাকী দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। বাড়িজুড়ে দেশী-বিদেশি গাছের সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা। পেছনে রয়েছে সান বাঁধানো ঘাট ও লেক। পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার জায়গা। বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করেছেন, এমন কয়েকজন জানান, বাড়িটিতে মতিউর রহমান মাঝেমধ্যে আসলেও প্রায় সবসময়ই লায়লা কানিজ থাকেন। এর ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামী জিনিসপত্রে ঠাসা। 


ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় একর বা তার বেশি আয়তনজুড়ে রয়েছে পার্কটির অবস্থান। ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য রয়েছে বেশকিছু রাইড। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই পার্কে ঘুরতে আসেন। এটি স্থানীয়দের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর পার্ক বলে প্রচারণা আছে। তবে ছাগলকাণ্ডের পর পার্কের লোকজন তা 'লাকীর পার্ক' হিসেবে অস্বীকার করছে। তবে লায়লা কানিজের দুই সন্তান যে এর পরিচালক, তা নিশ্চিত করেছেন তারা।

পার্কটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেওয়া আবুল খায়ের মানিক নামের একজন গণমাধ্যমকে জানান, লায়লা কানিজ পার্কের ভেতরের শুধু পুকুরের মালিক। তবে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মতিউর-লায়লা দম্পতির দুই সন্তান।

এদিকে নরসিংদী শহরের নাগরিয়াকান্দিতে গোল্ডেন স্টার পার্ক নামের অর্ধনির্মিত একটি বিনোদন কেন্দ্রে লায়লা কানিজ লাকী পার্টনার হিসেবে রয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ওই পার্কটির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক বাদল সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পার্কের সঙ্গে লায়লা কানিজ লাকী ও তার স্বামী মতিউর রহমানের কোনো মালিকানার সম্পর্ক নেই। ছাগলকাণ্ডে তাদের নাম চলে আসায় টিভি-পত্রিকায় তাদের দেখেছি, কিন্তু কোনদিন তাদের নিজের চোখে দেখিনি।

স্থানীয়রা বলছেন, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। পৈত্রিক বাড়িতে রাজপ্রাসাদতুল্য একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। ছোট পার্কটিকে ক্রমে ক্রমে আধুনিক করে ইকো রিসোর্ট তৈরি করেছেন। এলাকায় তিনি প্রচুর দান-খয়রাতও করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তিনি রায়পুরার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছেন।

মরজাল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিদা সুলতানা নাসিমা গণমাধ্যমকে বলেন, লায়লা কানিজ লাকি এই অর্থ দিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে  মানুষকে হয়রানি করছে।

রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, দুঃখের কথা কি আর বলবো? এমপি সাহেবের উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন লায়লা কানিজ। তিনি একটা টাকার পাহাড়। স্বামীর অবৈধ টাকার প্রভাবেই এমপি সাহেব তাকে গুরুত্ব দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন, যেন তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন। দলে কি আর কোন নেতা ছিল না? 

তিনি আরও বলেন, গত ৫৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। আমাকে পর্যন্ত প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, আপনার তো টাকা নাই, নির্বাচন কিভাবে করবেন? শুধু সমর্থন চেয়েছিলাম, তাও পাইনি। লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদ। এর জন্য ভবিষ্যতে আমাদের মূল্য দিতে হবে। টাকাই কি সব? আর এসব টাকা তো তার নিজের নয়, স্বামী মতিউর রহমানের।

এইচআ/ আই.কে.জে/

ছাগলকাণ্ড মতিউরের স্ত্রী

খবরটি শেয়ার করুন