শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ও আমিনার ভাগ্যবরণ

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪

#

মহসীন হাবিব
এ যেন মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে ব্যবহৃত মেঘবাণ, বজ্রবাণ, বিদ্যুৎবাণের যুদ্ধ। মহাভারতে যেন এই সময়ের ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছিল। বিগত দিনে পৃথিবীতে বহু দেশ অন্য দেশের উপর আক্রমণ শানিয়েছে, অন্য দেশের আক্রমণ প্রতিহত করেছে। কিন্তু আকাশে এমন আধুনিক প্রযুক্তি কুরুক্ষেত্রের বর্ণনার পর আর দেখা যায়নি। ইরান সাড়ে তিনশ মিসাইল, ব্যালেস্টিক মিসাইল, ড্রোন দিয়ে হামলা চালালো ইসরায়েলের উপর। এর মধ্যে ছিল ১৭০টি ড্রোন, ১১০টি ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং ৩০টি ক্রুজ মিসাইল। অধিকাংশই ইরান থেকে ছোড়া হলেও কয়েকটি ছোড়া হয় সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেন থেকে। এছাড়াও লেবাননের হেযবুল্লাহ গোষ্ঠী ইসরায়েলের গোলাইন হাইটস এলাকায় বেশ কয়েকটি রকেট নিক্ষেপ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল ইরানের ব্যালেস্টিক মিসাইল। এর একটি মিসাইলের গতি শব্দের গতির তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ। ইরান থেকে ইসরায়েলে প্রায় ১২শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে একটি মিসাইলের সময় লেগেছে ১৫ মিনিট। এর একেকটি মিসাইল তৈরিতে ইরানের খরচ পড়েছে সাড়ে তিন মিলিয়ান ডলার। ইরানের ড্রোন তৈরি করতে অন্যান্য দেশের তুলনায় কম খরচ হয়। ইরানের একেকটি সাহেদ-১৩৬ ড্রোন তৈরি করতে খরচ হয় ৫০ হাজার ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৭০ লাখের কাছাকছি। 

ইরানের এই আক্রমণের ৯৯ শতাংশ মধ্য আকাশেই আটকে দিয়েছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং জর্দান।  ১৪ তারিখ আক্রমণের ১০ দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন জানিয়েছিল, ইরান ইসরায়েলে হামলা করতে যাচ্ছে। সেই অনুসারে ইসরায়েলের পশ্চিমের বন্ধু রাষ্ট্রগুলি সামরিক প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল ইরানের হামলা প্রতিহত করার। 

ইরানও গোপন রাখেনি। আক্রমণের ৭২ ঘন্টা আগে আশেপাশের দেশগুলিকে সতর্ক করেছিল তাদের আকাশের উপর দিয়ে ইসরায়েলে মিসাইল যাবে সেই বার্তা দিয়ে। এমনকি এই আক্রমণের কথা যুক্তরাষ্ট্রকেও জানিয়েছে ইরান। ইরানের ধারণা ছিল এই হামলায় বেশিরভাগই প্রতিহত করবে ইসরায়েল, কিন্তু যতটুকু আঘাত করবে তা ইসরায়েলকে  যথেষ্ট ভোগাবে। কিন্তু তা হয়নি। কেবল একটি ব্যালেস্টিক মিসাইলের টুকরো ইসরায়েলের দক্ষিণ নেগেভ অঞ্চলের এক দরিদ্র আরব বেদুইন মোহাম্মদ আল হাসুইনির (আমরা যাকে বলি হুসাইনি) ঘরের চালে গিয়ে পড়ে।  তার সাত বছর বয়সী মেয়ে আমিনা আল হাসুইনি তখন ঘুমিয়ে ছিল। মেয়েটি গুরুতর আহত হয় এবং এখন সে ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে চিকিসাধীন রয়েছে। 

এই হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের ব্যয় হয়েছে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর ইরানের এই হামলা করতে কয়েক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। দুপক্ষের এত বিশাল ব্যয়ের আধুনিক আকাশ যুদ্ধের বিনিময়ে ফলাফল এক আরব বেদুইন সাত বছরের শিশুর আহত হওয়া। কিন্তু কেন এই বৈরিতা? কেনই বা ইসরায়েল এবং ইরানের বুকে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে? এই দুটি দেশের মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ইসরায়েল আরবদের যে কয়েকটি বড় যুদ্ধ হয়েছে সেগুলোতে ইরান কখনো অংশগ্রহণ করেনি। বরং ইসরায়েলিরা নিয়মিত ইরানিদেরকে দেশ পরিভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতো এবং একমাত্র ইরানকেই তারা অ-শত্রু দেশ বলে বিবেচনা করতো মধ্যপ্রাচ্যে।

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের পর ইরানই ছিল দ্বিতীয় দেশ যারা ১৯৪৮ সালে সার্বভৌম দেশ হিসাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ঘুটি ঘুরে যায় ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর। বিশেষ করে ইরান বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী ইসরায়েলকে ক্যানসার বলে অখ্যায়িত করার পর। ইরানের বিপ্লবীরা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ত্যাগ করে। শুরু হয় নতুন এক যুগের, যেখানে ধীরে ধীরে পাল্টে যায় পুরাতন সম্পর্কের ধারা। বন্ধু হয় শত্রু আর শত্রু হয় বন্ধু। যেমন সৌদি আরব, মিশর, জর্দানের মতো প্রধান শত্রু দেশ এখন ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের সবচয়ে বড় বন্ধু। 

একটা উদ্বেগ এই মুহূর্তে বিরাজ করছে। যুদ্ধ কি বড় আকার ধারণ করবে? বলা খুবই মুশকিল। ইসরায়েলের কেবিনেটের একটি পক্ষ ইরানের উপর প্রতিশোধমূলক হামলাকে সমর্থন করছে। অন্য পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেশ অনুসরণ করে এই মুহূর্তে ইরানে আক্রমণ না করার কথাই ভাবছে। কিন্তু তারা সবাই এতমত যে কোনোক্রমেই ইরানের পরমাণু প্রকল্প এগিয়ে নেওয়াকে মেনে নেবে না। ইসরায়েল মনে করে, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ফলে ইরানে আক্রমণ ইসরায়েল কর্তব্য মনে করে। এখন দেখার বিষয় সে আক্রমণ তারা কবে করতে চায়।
আই.কে.জে/

ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ

খবরটি শেয়ার করুন