বুধবার, ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৩রা আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা : ধারা অনুযায়ী যা যা করতে পারবে সেনাবাহিনী *** ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেলো সেনাবাহিনী *** অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না : তারেক রহমান *** ৪৩তম বিসিএস : স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরই নিয়োগ *** নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আশুলিয়ায় শনিবার থেকে বন্ধ কারখানা চালু *** ঢাকায় একদিনে ট্রাফিক আইনে ১৫২ মামলা, জরিমানা ৭ লাখ টাকা *** সাবেক রেলমন্ত্রীকে রিমান্ডে পাঠানোর পর আদেশ স্থগিত *** কোন স্ট্যাটাসে দিল্লিতে শেখ হাসিনা, জানে না অন্তর্বর্তী সরকার *** বাংলাদেশকে আরও ২ বিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক *** জীবিকা সংকটে শান্তিপ্রিয় খুমিরা || দরকার বিত্তবানদের সহযোগিতা

তঞ্চঙ্গ্যাদের আছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০২:৩৯ অপরাহ্ন, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৪

#

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে লিখেছেন সাংবাদিক নিখিল মানখিন। আজ প্রকাশিত হলো [২য় পর্ব]।

নিখিল মানখিন
বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো তঞ্চঙ্গ্যা। ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার জেলায় তাদের বসবাস। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা আছে। তারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী। তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। তাদের অনেকে ঐতিহ্যবাহী পেশার পরিবর্তে নতুন নতুন পেশায় যুক্ত হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষিতদের অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সুখবর ডটকমকে বলেন, বৃহত্তর পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার মানিকছড়ি, বিলাইছড়ি, বেতবুনিয়া, ওয়াগ্গা, কাপ্তাই, রাজস্থলী, রাইখালী, জুড়াছড়ি উপজেলার দুমধুম্যা ইউনিয়নে এবং বান্দরবান জেলার বালাঘাটা, সুয়ালক, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, পাইন্দু, রেমাক্রী, প্রভৃতি স্থানে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বসবাস। তাছাড়া কক্সবাজার জেলায় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসতি রয়েছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চলে (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (সিএডিসি) অঞ্চলে রয়েছে তাদের প্রধান বসতি। মায়ানমারের আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কোলদান নদীমুখ অবধি তাদের বসতি ছিল।

তাছাড়া আরাকানে ভুসিডং, রাচিডং, মংডু, ক্যকত, তানদুয়ে, ম্রামাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে এরা।

ভাষা:
আদিবাসী নেত্রী অর্ণব তঞ্চঙ্গ্যা সুখবর ডটকমকে বলেন, তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব ভাষা যেমন আছে, তেমনি নিজস্ব অক্ষর ও বর্ণমালাও আছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা পেলে তাদের ভাষার অক্ষর ও বর্ণমালা ব্যবহার, প্রসার এবং প্রচার ঘটবে। সেক্ষেত্রে জেলা পরিষদ, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতি কথা বলে মিশ্র ভাষায়। তাদের ভাষার মূল উৎস হচ্ছে পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত ইত্যাদি। এছাড়া ভারতীয় আর্যভাষা থেকে অনেক শব্দ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে, প্রবীণ তঞ্চঙ্গ্যারা কিছুটা আরাকানি ভাষায় কথাবার্তা বলে তাদের মনের ভাব বিনিময় করে।



পোশাক-পরিচ্ছদ:

সুরমা তঞ্চঙ্গ্যা সুখবর ডটকমকে বলেন, তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার আছে। চওড়া কালো বর্ডার সম্বলিত লাল জমিনের মধ্যবর্তী স্থান জুড়ে আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল হলুদ রঙের চিকন ডোরার সমাবেশ। এর প্রান্তদেশে একটি চওড়া লাল অংশ থাকে। দুই প্রান্ত আনুমানিকভাবে কালো ও ভিতরের দিকে লাল রঙের মাঝখানে লাল ও হলুদের একই মাপের দুই বর্ডার থাকে। লাল, সবুজ, বেগুনী, আকাশী রং মিশ্রিত প্রশস্থ প্লাটফরম থাকে। তাদের নিজস্ব পোশাক পরিচ্ছদও অলংকারে জড়ানো থাকে।

বিশেষত তঞ্চঙ্গ্যা নারীদের পোশাকে বৈচিত্র্যতা চাকমা নারী কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতির পাহাড়ি নারীদের থেকে আলাদা। তাই তঞ্চঙ্গ্যা রমনীদের খুব সহজেই চেনা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যা রমনীরা পায়ে, হাতে, বাহুতে, গলায়, কানে, চুলের খোপায় নানাবিধ অলঙ্কার ব্যবহার করে। পায়ে রূপার তৈরি মল, (ট্যাঙের খাড়ু), বাঘোর, কিঞ্চিক, বাঙড়ী বা চুড়ি ব্যবহার করে। বাহুর মধ্যে বাজু বন্ধক বা দাজজোড় পরিধান করে। কানে পরিধান করে রাজজুর/রাজজোড় কিংবা ঝংড়া। গলায় চন্দ্রহার বা হাঁচুলি ইত্যাদি পরিধান করে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে এই সব ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ধর্ম ও গোত্র:

বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তাদের মধ্যে রয়েছে সামাজিক আইন। রয়েছে বৈধ বিবাহঘটিত জাতীয় বিচার পদ্ধতি। তাছাড়া আরো রয়েছে অবৈধ বিবাহঘটিত জাতীয় বিচার ও দন্ডবিধি প্রদান।

তঞ্চঙ্গ্যাদের গোত্র বা গছাভেদে ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। তারা ১১টি গোত্র বা গছায় বিভক্ত। এগুলি হলো: মোগছা, কারওয়াগছা, ধন্যাগছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসাগছা, অঙয়োগছা, মুলিমাগছা, রাঙীগছা, ওয়াগছা, তাশীগছা।

পেশা:

আদিবাসী নেতা মৃণাল তঞ্চঙ্গ্যা সুখবর ডটকমকে বলেন, তঞ্চঙ্গ্যারা আগের মতো পুরোপুরি জুমচাষ নির্ভর নয়। তাদের মাঝে একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী পেশা হস্তশিল্প, পশুপালন, বস্ত্রবয়ন, শিকার প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে, তেমনিভাবে তারা আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিকাজ, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে চাকুরি বা জীবিকা গ্রহণ, ব্যবসা ও শ্রমনির্ভর নানা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। পরিবর্তনের এই ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে কেবল বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করছে তা নয়, বর্তমান সময়ের অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় ও পেশার সঙ্গেও যুক্ত করছে।

তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। নিজ গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্য সম্প্রদায় বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে মেলামেশা করছে। এভাবে তাদের অনেকে ঐতিহ্যবাহী পেশার পরিবর্তে নতুন নতুন পেশায় যুক্ত হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষিতদের অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।



তঞ্চঙ্গ্যাদের পরিবার কাঠামো:

অমল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা সুখবর ডটকমকে বলেন, তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্কের জালে আবব্ধ। এই জনগোষ্ঠী একটি সাধারণ ঐতিহ্য, প্রথা ও জীবন প্রণালী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একসাথে বসবাস করে আসলেও এখন তাতে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এখন তাদের মাঝে একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। ঐতিহ্যবাহী যৌথ ও বর্ধিত পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

শিক্ষা:

অমল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের হার খুব কম ছিল। সেই সময়ে এলাকায় স্কুল-কলেজের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। জাতীয় হারের তুলনায় কম হলেও বর্তমানে তাদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন লেখাপড়া শেখার জন্য ছেলেমেয়েদেরকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে থাকে অভিভাবকরা। এসএসসি থেকে ডিগ্রী পড়ুয়া তঞ্চঙ্গ্যা ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। তাদের সমাজে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষাথীর সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন। বর্তমানে মাধ্যমিক উত্তীর্ণের হার প্রায় ১৭ শতাংশ।

আই.কে.জে/

তঞ্চঙ্গ্যা

খবরটি শেয়ার করুন