সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৭ই মার্চের ভাষণ: বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০১:৪৪ অপরাহ্ন, ৬ই মার্চ ২০২৪

#

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল প্রকৃত পক্ষেই স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর চব্বিশ বছরের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে এই ভাষণটি ছিল অবিস্মরণীয়। বাংলার জনগণের ভোটে  নির্বাচিত নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মুক্তিকামী জনগণের সামনে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ভাষণটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা। মুক্তিযুদ্ধের  পুরোটা সময় মুক্তিপাগল মানুষের মাঝে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু তাঁর এই ১৯ মিনিটের  ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের  দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন। ভাষণে সামরিক শাসকদের উদ্দেশে চারটি শর্ত দিয়েছিলেন (১) মার্শাল ল' প্রত্যাহার কর (২) সেনা বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে  নিতে হবে (৩) এই কয়দিনের হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত (৪) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেছেন- আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকার প্রধানের মতো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি,তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে।’ অর্থ্যাৎ তিনি স্পষ্ট করে অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিলেন তিনি অনুপস্থিত থাকলেও কিভাবে শত্রুর মোকাবেলা করে যুদ্ধ করবে তার সমাধান দিয়ে গেছেন। 

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা স্পষ্ট করেছেন। জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে বার্তা নিতে এসেছিলেন,ভাষণে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি শুধু চেয়েছিলেন আঘাতটা পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে আসুক। তা না হলে বিছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তারা বিদেশিদের কাছে তুলে ধরবে। বক্তব্যে তিনি কৌশলী ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে  ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিট ফ্রষ্টকে ৭ মার্চের বক্তব্য নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশেষ করে আমি ওই দিনটা কিছু করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদেরকে (পাকিস্তান) আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে,শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তাই আঘাত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত করুক এবং জনগণ আঘাতকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত আছে’। জনগণের প্রতি এ বিশ্বাস আমার ছিল। 

ভাষণটিকে বিশ্বের বরেণ্য রাজনীতিবিদগণ ও প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও যুদ্ধের রণকৌশল ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিউবার জাতীয়তাবাদী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো ভাষণটি সম্পর্কে বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণটি শেখ মুজিবুর রহমানের শুধু ভাষণই নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশল দলিল। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা হয়ে শক্তি জোগাবে। প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘নিউজউইক’ তার রিপোর্টে বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবলমাত্র একটি ভাষণ নয়,অনন্য কবিতা। এবং বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছে রাজনীতির কবি (The poet of politics) হিসেবে। ওয়াশিংটন পোস্টে মন্তব্য করা হয়- ‘শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা।’

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে ৪১ জন নেতার বক্তব্যকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘Speeches that inspired History' শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভাষণটি এখন শুধুমাত্র দেশেরই সম্পদ নয়, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা। পেরিক্লিস, আলেকজান্ডার, হ্যানিবল, জুলিয়াস সিজার, সালাদিন, নেপোলিয়ন, গ্যারিবল্ডি, আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন, এডলফ হিটলার, চার্চিল, মাও সেতুং, রুজভেল্ট, স্টালিন, হো চি মিন প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত নেতাদের বক্তব্য স্থান পেয়েছে।

১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট গেটিসবার্গে বলেছিলেন,‘Government of the people, by the people, for the people'। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন,‘এ মুহূর্তে দেয়ার মতো কিছুই নেই আমার। আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম।' আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা পেট্রিক হেনরি ১৭৭৫ সালে ভার্জিনিয়া কনভেনশন ঘোষণা করে বলেছিলেন,‘আমাকে স্বাধীনতা দাও,নয়তো মৃত্যু।’ তাঁর ভাষণটি আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করে। আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস', উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’, জওহর লাল নেহেরুর ‘ট্রাইস্ট ইউথ ডেস্টিনি’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এই চারটি ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে তুলনা করেছেন। অন্যান্য ভাষণ থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, একটি ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার কাব্যিক এরকম ঘোষণা সত্যি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ও অতুলনীয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭  মার্চের ভাষণের বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা। এ ভাষণটি পৃথিবীর যেকোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠির জন্য সব সময় কাজ করবে। গণতন্ত্র, স্বাধীকার, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথাগুলো বলেছেন। সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন।  সে সময় জনগণ যা জানতে চেয়েছেন তিনি তাই-ই বলেছেন।  একটি ভাষণ সমগ্র বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। নয় মাসের  মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন মহানায়ক, এই ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। ভাষণটি আজ দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে সার্বজনীন হয়েছে। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণটি  ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণটি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com


৭ই মার্চের ভাষণ

খবরটি শেয়ার করুন