সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের নিরপেক্ষতা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০১:২৭ অপরাহ্ন, ১৪ই আগস্ট ২০২৩

#

প্রতীকী ছবি

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন পুরো বিশ্বকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এব্যাপারে নীতিনির্ধারকরা এখন ভারতের দিকে বেশি মনোনিবেশ করছেন। কেননা বৈশ্বিক শক্তির গতিশীলতাকে নতুন আকার দেওয়ার ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা দেশটির রয়েছে। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। আর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে তার দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন।

এবছর সেপ্টেম্বরে দেশটিতে জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এটিকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের শেষ দিকে বিলবোর্ড আর ব্যানারে ভরা ছিল নয়াদিল্লী। এই বিলবোর্ডগুলোতে জি-২০ এর লোগোর পাশে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র  মোদিকে বিশেষভাবে দেখানো হয়েছে। 

সম্মেলনে উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান দেশগুলোর সফল প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার আশা করছে দেশটি। এই আশা পূর্ণ হলে ভারত কোন ধরনের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে তাই এখন প্রশ্ন। 

ভারত এখনও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করেনি এবং এখন পর্যন্ত ভারত মস্কোর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। যদিও দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সাথে কোয়াড সুরক্ষা অংশীদারিত্বের সদস্য, তবুও পশ্চিমা দেশসমূহ এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রে ভারত সবসময় নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে।

এতকিছুর পরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে পারে। কেননা জুনের শেষ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান এবং সেখানে তিনি ওয়াশিংটনের সাথে শক্তিশালী ও বড় পরিসরে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে একমত হন। এব্যাপারে ওয়াশিংটন ও দিল্লীর মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এতে দুই দেশের যৌথভাবে ফাইটার জেট ইঞ্জিন উৎপাদন এবং ভারতে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের সুবিধা দেওয়ার মতো বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে। জুলাই মাসে মোদি ফ্রান্স সফরে যান এবং দেশটির থেকে ২৬ টি ক্যারিয়ার বেসড এয়ারক্রাফ্ট ও তিনটি সাবমেরিন কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

স্পষ্টতই, চীনা সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের সাথে অস্ত্র সহযোগিতা চুক্তি প্রসারিত করছে। দেশটি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য লড়াই করছে। 

উল্লেখ্য ভারতের আমদানিকৃত অস্ত্রের অর্ধেকেরও বেশি আসে রাশিয়া থেকে। 

ভারতীয় মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র উপদেষ্টার মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশটিতে রাশিয়ান সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহে বিলম্ব হওয়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সাথে অস্ত্র সহযোগিতা চুক্তি করেছে দেশটি। তিনি আরো জানান, ট্যাঙ্কের নির্দিষ্ট কিছু উপাদান সরবরাহে প্রায় এক বছর বিলম্ব হয়েছে। 

অস্ত্রের অংশগুলি ঘন ঘন প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। কেননা এটি ছাড়া সামরিক প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যদি ভারতের সামরিক শক্তি হ্রাস পায় তবে চীন আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে এবং ভারত-চীন সীমান্তে ও ভারত মহাসাগরে উত্তেজনা আরো বাড়বে। এ উত্তেজনার সম্ভানায় উদ্বিগ্ন হয়ে এবং ভারত ও চীনের মধ্যে সামরিক শক্তির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ভারতকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছিল।

ভারত তার সামরিক বাহিনীকে আরো আধুনিক করার জন্য জাপানের সহায়তারও প্রত্যাশা করছে। গত ২৮ ও ২৯ জুলাই নয়াদিল্লিতে ভারত-জাপান ফোরামে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ফোরামে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অর্থনীতি, পণ্যের যোগান, আধুনিক কলা-কৌশল, প্রযুক্তি এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তায় সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। অনেক ভারতীয় কর্মকর্তাও জাপানের থেকে সামরিক সরঞ্জাম এবং নৌ জাহাজ নির্মাণের বিষয়ে বৃহত্তর প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের থেকে সামরিক ও প্রযুক্তি সহযোগিতা গ্রহণ করে ভারত যে কার্যকরভাবে পশ্চিমাদের আধা-মিত্র হয়ে উঠবে তা আশা করাটা ভুল। নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করে যে এই ধরনের পথ তার কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।

পশ্চিমাদের সাথে সীমিত মৈত্রী চাওয়ার প্রতি ভারতের অনীহার অন্তত তিনটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, একজন প্রাক্তন সিনিয়র ভারতীয় সামরিক অফিসারের মতে, ব্রিটিশদের দ্বারা ঔপনিবেশিক হওয়ার থেকে ভারত যে প্রধান শিক্ষাটি পেয়েছে তা হল যে তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নিজের আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন। ভারতের পরাধীনতার ঔপনিবেশিক ইতিহাসও ইউরোপের প্রতি অবিশ্বাসের অনুভূতি জাগিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত তার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। দেশটি কোনো জোটের দ্বারা আবদ্ধ হতে চায় না। কারণ জোট গঠনকারী দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলা আরও কঠিন। অনেক সময় কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় সংঘর্ষে জড়িয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। 

২০২১ সালের নভেম্বরের শেষ অবধি নৌবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী করমবীর সিং বলেছেন, "স্নায়ু যুদ্ধের যুগের মতো জোটগঠন এখন আর কোন আদর্শের মধ্যে পড়ে না। বরং এটির বদলে, বাস্তবসম্মত অংশীদারিত্ব আরও বেশি উপযুক্ত যা আজকের ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।"

তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সাথে জোট গঠন করলে বেইজিংয়ের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এতে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে। এর আগেও সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে।

এছাড়া ভারত এ ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন যে, পশ্চিমাদের খুব কাছাকাছি চলে গেলে মস্কোর সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। এতে করে রাশিয়া থেকে তাদের সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই ভারত যত দ্রুতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে অস্ত্র আমদানি বাড়াক না কেন রাশিয়ার অস্ত্র থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে তাদের কয়েক বছর লেগে যাবে।

ভারতের সাথে কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্ক আরও গভীর করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়গুলি মনে রাখা উচিত।

তারপরও পশ্চিমাদের ভারতের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর জায়গা আছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি তাইওয়ান প্রণালী বা দক্ষিণ চীন সাগরে কোনো সংঘাত শুরু হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে পরোক্ষ সহযোগিতা পেতে পারে। যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনীর এতে সরাসরি জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম তবুও এই অঞ্চলের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা থেকে চীনকে বিরত রাখতে চায় ভারত। কেননা এতে ভারত মহাসাগরের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।

রাশিয়ান-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে একাধিক ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার ভুল পদক্ষেপে মোদি প্রশাসন ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছে। তারা এব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে যদি রাশিয়ার শক্তি কমে যায় এবং চীনের উপর তাদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় তাহলে ভারতের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

ভারত এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। সকল দেশের সাথে তারা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছে। 

এম.এস.এইচ/

চীন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ভারত

খবরটি শেয়ার করুন