শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কঠোর হচ্ছে সিঙ্গাপুর, অর্থ পাচারকারীরা চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০২:০৮ অপরাহ্ন, ২০শে আগস্ট ২০২৩

#

সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার ‘বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’ বলা হয়। আবার  কুখ্যাতি আছে। পাচার করা টাকা লুকিয়ে রাখার জন্য সিঙ্গাপুর অনেকেরই পছন্দের জায়গা। সেই সিঙ্গাপুর অনেকের জন্যই রহস্যময় আচরণ করেছে বলা যায়। 

কর ফাঁকির ‘অভয়ারণ্য’ বলে দুর্নীতিবাজদের কাছে যে সিঙ্গাপুর ছিল ‘ভরসার জায়গা’ সেই সিঙ্গাপুরকে এখন আর কর ফাঁকির অভয়ারণ্য মনে করতে পারছেন না তারা। ফলে অর্থ পাচারকারী অনেকেই সিঙ্গাপুর থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাচ্ছেন। অনেকে চলেও গেছেন। অর্থ পাচারকারীদের নতুন গন্তব্য দুবাই ও সাইপ্রাসের মতো এলাকা, যেখানে অর্থ লুকিয়ে রাখা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সিঙ্গাপুর থেকে অর্থ পাচারকারীরা চলে যাচ্ছেন।

অর্থের অবৈধ ব্যবহার সারা বিশ্বের জন্যই বড় মাথাব্যথা। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে অবৈধ অর্থপ্রবাহের পরিমাণ আটশ বিলিয়ন থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৫ শতাংশ। আবার দেখা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির যে আকার, তার তুলনায় দেশটির আফশোর তহবিল বহুগুণ বেশি। যেমন মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের (এমএএস) তথ্য হচ্ছে, সিঙ্গাপুরের জিডিপি হচ্ছে ৬৪০ বিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার (৪৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। আর দেশটি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে, যার ৮০ শতাংশ অর্থই সিঙ্গাপুরের বাইরে থেকে আসে।

বারাক ওবামা ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট (এফএটিসিএ)’ নামের গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস করেছিলেন। এটি মূলত মার্কিন নাগরিকদের কর ফাঁকি বন্ধের আইন। আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নয়, এমন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও মার্কিন নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন না মানলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেউ ব্যবসা করতে পারবেন না। এর পরেই আরও অনেক দেশ একই ধরনের আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। আবার ২০১৪ সালে জি-২০ ও ওইসিডিভুক্ত ৪৭টি দেশ এই লক্ষ্যে তথ্য আদান-প্রদানের একটি অভিন্ন প্রক্রিয়া বা ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর একটি কাঠামো গড়ে তোলে। মূলত এটি একটি স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামো বা অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন ব্যবস্থা। ২০১৭ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। এসবের ফলে সুইস ব্যাংকসহ অন্যরাও তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি কর ফাঁকি যারা দেয়, তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাংকগুলোকে মোটা অঙ্কের জরিমানাও দিতে হচ্ছে।

সিঙ্গাপুর অবশ্য নড়েচড়ে বসে মালয়েশিয়ার কুখ্যাত ওয়ান মালয়েশিয়ান ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ বা ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির পর থেকে। ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে এই রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এই তহবিল থেকে হাওয়া হয়ে যায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার। সেই অর্থ গেছে কয়েক ব্যক্তির পকেটে। এর মধ্যে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকও ছিলেন। চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী লো তায়েক ঝোকে বলা হয় এই কেলেঙ্কারির হোতা। ২০১৩ সালের বিখ্যাত হলিউড সিনেমা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর দ্য উলফ অব ওয়ালস্ট্রিট এর অন্যতম লগ্নিকারী ছিলেন তায়েক ঝো এবং নাজিব রাজাকের সৎপুত্র রিজা আজিজ। এই সিনেমার অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে গিয়েই সাংবাদিকেরা এই কেলেঙ্কারির রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছিলেন। মূলত ছয়টি দেশের ব্যাংক–ব্যবস্থা ব্যবহার করেই এই অর্থ পাচার করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সিঙ্গাপুর। ফলে বদনামের ভাগী হওয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক মহলেও চাপের মধ্যে পড়ে যায় সিঙ্গাপুর। এরপরে নিজেদের নিষ্কলুষ করতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে দেশটি। 

গত মঙ্গলবার বিদেশ থেকে পাচার করে আনা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের অর্থসম্পদ জব্দ করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স (এসপিএফ) পরিচালিত এই অভিযানকে দেশটির ইতিহাসে মানি লন্ডারিংবিরোধী সবচেয়ে বড় অভিযানগুলোর একটি বলা হচ্ছে। অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারীসহ ১০ জনকে। এ ছাড়া আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। আর আটজন সন্দেহভাজন পলাতক। এই ব্যক্তিরা ধনী এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। বিলাসী জীবন যাপন করতেন। সিঙ্গাপুরের পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের অভিযানে ৯৪টি জমি এবং ৫০টি গাড়ির নামে নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, মালিকেরা এসব জমি ও গাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না। এসব জমি ও গাড়ির মোট মূল্য ৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে। অভিযানে ৩৫টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এসব অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি ডলারের বেশি অর্থ জমা রয়েছে। এ ছাড়া জব্দের তালিকায় রয়েছে অনলাইনে সম্পদ থাকার ১১টি নথি, ২টি সোনার বার, ২৫০টির বেশি দামি ব্যাগ ও ঘড়ি, ১২০টির বেশি মুঠোফোন ও কম্পিউটার, ২৭০টির বেশি দামি অলংকার। জব্দ করা অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি।

আই. কে. জে/ 

সিঙ্গাপুর অর্থ পাচারকারী

খবরটি শেয়ার করুন