সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে, ঢাকা পারছে না কেন?

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৬:৩৮ অপরাহ্ন, ১৪ই জুলাই ২০২৩

#

ছবি: ডা. মুশতাক হোসেন

ডা. মুশতাক হোসেন

ডেঙ্গুর প্রকোপ শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই; গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ গ্রামাঞ্চলেও শহরের মতো স্থাপনা ও অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে এখন। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ফুল বা ফলের টব, যত্রতত্র ফেলে রাখা ডাবের খোসায় পানি জমছে। অনেকে বোতলজাত পানি অর্ধেক পান করে বোতলটি ফেলে দেন। টবে কিংবা বোতলের পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ এলাকায় এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য দায়ী উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ডেঙ্গু মহামারি রোধ করা যাবে না।

মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু এখন আর উচ্চবিত্ত তথা বড় দালানে বসবাস করা বাসিন্দাদের রোগ নয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এডিস মশা জন্মানোর সুযোগ বেশি থাকায় এতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরীর সব লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না। উদাসীন থাকলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

একসময় মনে করা হতো, বর্ষা এলেই ডেঙ্গু চোখ রাঙায়। কিন্তু ২০২২-২৩ সালে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব, সারাবছর কমবেশি ডেঙ্গুর প্রবণতা ছিল। তাই এটি এখন আর মৌসুমি রোগ নয়। শীতকালেও যেভাবে এডিস মশার প্রজনন লক্ষ্য করা গেছে, তাতে এটি স্পষ্ট। এখন আমাদের দায়িত্ব মশা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা।

এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য বৃষ্টি একমাত্র উৎস নয়। এ কারণে পরিষ্কার পানি জমতে দেওয়া যাবে না। নির্মাণকাজ ও কৃষিকাজে পরিষ্কার পানি ব্যবহৃত হয়। এসব পানি কোথাও জমে থাকার সুযোগ পেলেই সেখানে এডিস মশার লার্ভা দেখা যায়। তাই শ্রমিক ও কৃষকদের সতর্ক থাকতে হবে। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোথাও পানি জমে থাকতে দেখলে তা অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে স্থানীয়দের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। মশক নিধনের দায়িত্ব এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত। বাস্তবতা হলো, একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মশক নিধন, বিশেষ করে এডিস মশা নিধন করা সম্ভব নয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য, কৃষিসহ যেসব মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে।

আমাদের দেশে ডেঙ্গুর চারটি ধরন এই মুহূর্তে সক্রিয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধরনে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ভারতে পঞ্চম ধরন শনাক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়বার যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, তাদের রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেশি। এ জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্তদের ব্যাপারে আলাদা যত্ন নিতে হবে।

রোগ ছড়ানোর চক্র অর্থাৎ এডিস মশার বংশবিস্তার রোধের বিকল্প নেই। সিটি করপোরেশন যেভাবে অভিযান আর জরিমানা করছে, তাতে সুফল মিলবে না। কীটতত্ত্ববিদদের সম্পৃক্ত করে অভিযান চালাতে হবে। কারণ, তারাই বুঝবেন কোথায় লার্ভা রয়েছে। এ জন্য দক্ষ জনবল নিতে হবে। সিটি করপোরেশন যেভাবে কীটনাশক ছিটায়, তা ঘরের মধ্যে বা ছাদে থাকা লার্ভা ধ্বংস করতে পারে না। এ জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সমন্বয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে দিতে হবে। তাদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চা-নাশতা করিয়ে টি-শার্ট পরিয়ে অভিযানে নিয়ে যেতে হবে। তারাই তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করা গেলে মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে। এ জন্য জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে।



বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও ২০১৭ সালে একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে। এর আওতায় কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ানো রোগ নিয়ন্ত্রণে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সংস্থাটি। কর্মকৌশলের প্রথম ধাপ ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে পরবর্তী ধাপ। আমাদের দেশেও কীটপতঙ্গবাহী রোগ নিয়ন্ত্রণে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ; চিকিৎসা কোনোটাই সম্ভব নয়। এ কাজে সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত না করে পেশাদার লোকজন কাজ করে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। এ জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। শহরেও এ ধরনের ক্লিনিক খোলা দরকার। এসব ক্লিনিকে ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। করোনার চেয়েও ডেঙ্গুর টেস্ট সহজ। তারপরও সরকার যদি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আমাদের দেশে এমনিতেই রোগী ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব। ফলে গুরুতর রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা হবে আত্মঘাতী।

বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলি। ডেঙ্গু রোগীদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সাধারণ ডেঙ্গু রোগী, যাদের মধ্যে জ্বরসহ প্রাথমিক উপসর্গ দেখা যায়। এসব রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আলাদা ঘরে মশারি টানিয়ে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের মানুষ হলে তাদের নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিকে ভর্তি করে মশারি টানিয়ে রাখা যেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হলে সরকারি-বেসরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুরা। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগের মতো জটিল রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। তৃতীয় ভাগের রোগীদের জন্য প্লাটিলেট, আইসিইউ, লাইফ সাপোর্ট দরকার হতে পারে।

আমাদের দেশে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে সাধারণ রোগীরা গিয়ে আইসিইউ দখল করে রাখে। ফলে জটিল রোগীরা বঞ্চিত হয়। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল রোগী আইসিইউ সুবিধা পেয়ে যান বেসরকারি হাসপাতালে। অন্যদিকে অসচ্ছল রোগী অর্থের অভাবে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেই সুবিধা পান না। এ জন্য দেশের সব হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসক সংকট দূর করতে হবে। শুধু চিকিৎসক নন; নার্স, টেকনিশিয়ান– এককথায় স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট দূর করা না গেলে তৃণমূলে সেবা পৌঁছানো সম্ভব নয়। আবার ডেঙ্গু হলেই গণহারে হাসপাতালে ভর্তি না করে বাছাই করে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে জটিল রোগীরা চাহিদা অনুযায়ী সেবা না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

আরো পড়ুন: মশা নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজের পরিধি বাড়ানোর আহ্বান : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রথম দিকে গুরুত্ব দিলে আমাদের দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হতো না। যে কোনো সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে শুরুতেই নিয়ন্ত্রণে নিতে হয়। দেখা যায়, হেলাফেলা করার কারণে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আমরা পারিনি উদাসীনতার কারণে। আমরা ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, বাতজ্বর নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। চেষ্টা করলে ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য অব্যাহত জরিপ চালাতে হবে।

ডা. মুশতাক হোসেন: রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)

এম এইচ ডি/ আইকেজে 

জনস্বাস্থ্য কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ঢাকা এডিস মশার লার্ভা সংক্রামক ব্যাধি

খবরটি শেয়ার করুন