সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কানাডার আদালতের রায় এবং বাংলাদেশে বিএনপির কর্মকান্ড

অরুণ কুমার গোস্বামী

🕒 প্রকাশ: ১২:৪৬ অপরাহ্ন, ৩রা আগস্ট ২০২৩

#

আগস্ট শোকের মাস। কাকতালীয় হলেও, ১৯৭৫ এবং ২০০৪ এর আগস্টের মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনা প্রবাহের সাথে কানাডার আদালতের রায়ের কী কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে? প্রথমত এটি শোকের মাস আগস্ট, দ্বিতীয়ত কানাডার আদালত কর্তৃক বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা সম্পর্কিত আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা, তৃতীয়ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়া। এইসব বিষয়ে আলোচনাই বর্তমান লেখাটির উদ্দেশ্য সীমিত থাকছে! 

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকার প্রধান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি রক্তপিপাসু হায়েনার দল। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী খুনীদের সাক্ষ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বেনিফিশিয়ারিও বটে! নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হত্যার কথা শোনার পর সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান খুব সকালে শেভ করতে করতে  ‘প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো হোয়াট!’ বলে যে অভিব্যক্তি দিয়েছিলেন, তাও খুনে রাঙ্গা ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত উক্তি হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে! এছাড়া একজন নির্বাচিত সরকার প্রধানকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যাকারীদের বিচার চিরতরে বন্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং পরবর্তীকালে ইনডেমনিটি আইনে জিয়ার সক্রিয় উৎসাহ ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছে। জিয়ার সম্মতি ছাড়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপি দলীয় আসন সমৃদ্ধ জাতীয় সংসদে এটি আইনে পরিণত হওয়া কী সম্ভব ছিল? সম্ভব ছিল না! পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর খুনীরা জিয়ার প্রেরণাতেই ‘ফ্রিডম পার্টি’ গঠন করেছিল। শুধু তাই নয় জিয়াউর রহমান এবং তার উত্তরসূরী প্রত্যেকেই এইসব খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকুরি দিয়েছে। এসবই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া কলঙ্কিত ইতিহাস! 

কানাডার আদালত হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের গভীরে উন্মোচন করতে চান নাই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড পরবর্তীকালে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজে সরাসরি ক্ষমতা দখল করার লিপ্সায় বিচারপতি সায়েমকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। “অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেইস” বইয়ের শেষ অংশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম  বলেছেন, ‘মধ্যরাতে অস্ত্র হাতে বঙ্গভবনে আসেন জিয়া। তার সঙ্গীরা তাদের অস্ত্র তুলেছিল... আমি ভেবেছিলাম এটাই সম্ভবত আমার শেষ রাত... একদিন রাতে সে আমার বিছানায় একটা কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, সই কর... আমি কাগজটা পড়ি। এটা ছিল আমার পদত্যাগপত্র। তাতে লেখা আছে, ‘আমি অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’ আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আট থেকে দশজন অস্ত্রধারী অস্ত্র হাতে আমার বিছানা ঘিরে ফেলেছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় তার পা তুলে, তার অস্ত্রটি আমার বুকে লক্ষ্য করে বললেন, সই করো। পদত্যাগপত্রে সই করে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়েছি...।’ প্রেসিডেন্টের বুকে অস্ত্র তাক করে তাঁকে পদত্যাগপত্রে সই করার ব্যাপারটি কানাডার আদালত বিবেচনায় নিলে বোধ করি গোটা বিএনপিকে চিরতরে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে কালো তালিকাভূক্ত করার রায় দিতেন। 

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক উইলিয়াম বর্ডারস ৭ জুন, ১৯৭৮-এ তার প্রতিবেদনে জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একজন কঠোর এবং কখনও কখনও নির্মম সামরিক ব্যক্তি যিনি দৃশ্যত নির্বিকার ছিলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এমন সন্দেহের বশবর্তী হয়ে জিয়া অসংখ্য সৈন্যের গোপন বিচার এবং মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছেন।’  উইলিয়াম বর্ডারসের মতে, ‘জেনারেল জিয়া স্পষ্টতই. . . কোনও গণতন্ত্রী নন।’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা, দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হওয়ার এটাই হচ্ছে ইতিহাস!

সবকিছু তার মূলে ফিরে যাওয়া সম্পর্কিত একটি ঐশী বাণীর কথা আমরা সবাই জানি! সামরিক শাসনাধীনে এবং দেশের প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিএনপি-ও সৃষ্টি এবং এগিয়ে যাওয়া ও টিকে থাকা সবই সন্ত্রাস নির্ভর। 

২৫ মার্চ ২০০৮ তারিখে প্রকাশিত যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টারি রিপোর্টে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোটের দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা পরিচালিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘গণধর্ষণ হল পছন্দের অস্ত্র কারণ যখন একটি মেয়ে ধর্ষিত হয় তখন পরিবার তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ভারতে চলে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরে এক রাতে এক জায়গায় ২০০ হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। হিন্দু মা ও মেয়ে একসঙ্গে ধর্ষিত হয়েছিল যাতে তারা দেশে থাকতে সাহস না পায়। এমনকি এসময় প্রতিবন্ধী এবং ৭০ বছরের বৃদ্ধা নারীদেরও ধর্ষণ করা হয়।

সংখ্যালঘুরা জনসংখ্যার ১০% এরও কম প্রতিনিধিত্ব করে তবে ৯৮.৭% ধর্ষণের শিকার ছিল সংখ্যালঘু। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে জঙ্গি ইসলামের তাৎপর্যপূর্ণ উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা অন্যান্য জঙ্গি ইসলামিস্টদের সাথে মিলে দেশে বসবাসকারী  ক্রমহ্রাসমান  সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর নৃশংসতা চালাচ্ছিল।’

কানাডার আদালতের সূত্র উল্লেখ করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সময় টেলিভিশনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে একটি সন্ত্রাসী দল হিসাবে পুনরায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। কানাডায় অভিবাসনের আশা পোষণকারী একজন বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য কানাডায় বসবাসের বাসনা নিয়ে আবেদন করেছিলেন কানাডার সরকারের কাছে। আবেদনকারী মোহাম্মদ জিপসেদ ইব্নে হক এবং কানাডার দ্য মিনিস্টার অব পাবলিক সেফ্টি এন্ড ইমারজেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস এর মধ্যে মামলায় বিচারক এন্ড্রু ডি. লিট্ল এর উপস্থিতিতে যে শুনানী, রায় এবং কারণসমূহ অফিসিয়াল ডকেট নম্বর আইএমএম-৫৮৪৪-২২ তারিখ: ১৫ জুন ২০২৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে তার মাধ্যমেও এবিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।

দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে আবারো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে অভিহিত করলো কানাডার আদালত! এনিয়ে পঞ্চমবারের মত কানাডার আদালতে বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো। গত ১৫ জুন একটি জুডিসিয়াল রিভিউয়ের আবেদন নিষ্পত্তিকালে কানাডার ফেডারেল কোর্টোর বিচারক বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে অভিধা দেন। দলটির এক কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণা নাকচ করে দেয়ার বিরুদ্ধে ওই জুডিসিয়াল রিভিউটি দায়ের করা হয়েছিল। কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ডের ইমিগ্রেশন ডিভিশন (আইডি) এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে অভিবাসন ও শরণার্থী সুরক্ষা আইন, S.C. ২০০১, প ২৭ (IRPA) এর অনুচ্ছেদ ৩৪(১)(f) এর অধীনে নিরাপত্তার কারণে আবেদনকারী কানাডায় অগ্রহণযোগ্য ছিলেন কারণ তিনি বিএনপি-র সদস্য ছিলেন।

মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামে ওই ব্যক্তি বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার উল্লেখ করে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণা করেণ। এই রায়ের রিভিউতে দেশটির ফেডারেল কোর্ট উল্লেখ করে আবেদনকারী ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য ছিলেন। কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ অভিবাসন ও শরণার্থি সুরক্ষা আইনের অনুচ্ছেদ ৩৪(১)(এফ) অনুসারে আবেদনকারী মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হকের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। অভিবাসন কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীর বিরুদ্ধে অভিবাসন ও শরণার্থি সুরক্ষা আইনের অনুচ্ছেদ ৪৫ (ডি) অনুসারে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একটি নির্বাসন আদেশ জারি করেছে। 

কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছিল যে বিএনপি এমন একটি সংগঠন যা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে নাশকতার সাথে জড়িত বা প্ররোচিত করেছিল। বিএনপিকে সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত সংগঠন বলে বিশ্বাস না করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায়নি কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।

কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বিএনপি-কে এমন একটি সংগঠন হিসেবে গণ্য করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছে যারা বলপ্রয়োগ ও নাশকতায় জড়িত থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলনা তা বিশ্বাস না করার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায় নি কানাডার আদালত। রায়ে কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি সুরক্ষা আইন (আইআরপিএ) অনুযায়ী আবেদনকারীকে কানাডায় বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করতে বলা হয়। যে আইন বলে এই কথা বলা হয় সেখানে বলা হয়েছে, “৩৪(১) একজন স্থায়ী বাসিন্দা বা একজন বিদেশী নাগরিক নিরাপত্তার কারণে অগ্রহণযোগ্য

(বি) যে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া বা প্ররোচিত করা

(বি.১.) কানাডায় ধরে নেওয়া হয় এমন ভাবে যাতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার, প্রতিষ্ঠান বা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া,

(সি) সন্ত্রাসে জড়িত।”

অভিবাসন ও শরণার্থি সুরক্ষা আইনের অনুচ্ছেদ ৩৪(১)(এফ) অনুসারে আবেদনকারী মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হকের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।

২০১৭ সালে জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মী রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণাও নাকচ করা হয়েছিল কানাডার আদালত কর্তৃক। ২০১৮ সালে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, ওই একই বছর কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী বিএনপি কর্মী মাসুদ রানা, ২০২২ সালে ছাত্রদল কর্মী সেলিম বাদশার অভিবাসন আবেদন নাকচ করার সময়ও বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে উল্লেখ করে কানাডার আদালত।

কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এমন মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছে যারা বল প্রয়োগ ও নাশকতামূলক কাজে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজে লিপ্ত বিএনপি তেমনই একটি সংগঠন। বিএনপি সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল না তা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায় নাই। ২০০১ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালীন সময়ে এবং নির্বাচনের পরে বিরোধী আওয়ামী লীগ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির ওপর যে নারকীয় হামলা, হত্যাকান্ড, ও ধর্ষণ প্রভৃতি বিএনপি-জামাত ক্যাডাররা সমগ্র বাংলাদেশে চালিয়েছে তা বিবেচনায় নিলে কানাডার আদালতের রায় আরও কঠোর হতে পারত! ২০১৪ সালের নির্বাচন বাঞ্চাল করার জন্য পেট্রল বোমা হামলার যে কলঙ্কিত নজির স্থাপন করেছে বিএনপি-জামাত জোট তার তুলনা তারা নিজেরাই। এছাড়া দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে অনেক নিরীহ বাঙালির প্রাণসংহার করেছে জামাত-বিএনপির ক্যাডাররা!

 শোকের মাস আগস্ট! শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রয়োজনে এই মাসটি পিতার ঘাতকদের চিহ্নিত করার জন্য উপযুক্ত! মেজর জিয়াউদ্দিনসহ কয়েকজন জাসদপন্থী সামরিক অফিসার ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট খুব সকালে শাহবাগস্থ বাংলাদেশ বেতার ভবনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। মেজর জিয়াউদ্দিনের একজন নারী অনুসারী, তিনিও জাসদের গণবাহিনীর সদস্য ছিলেন। কীভাবে তিনি আত্মীয়স্বজনের সক্রিয় সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার জন্য ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুণকীর্তন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে আওয়ামী লীগের অবস্থানের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যও হয়েছিলেন! এই ছদ্মবেশী আওয়ামী পন্থী গবেষণার ফলাফলের মূল বক্তব্য ছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়’! আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা পুষ্ট হয়ে করা এই গবেষণা আওয়ামী লীগের জন্যই আত্মঘাতী! সংগ্রাম ও গৌরবের দীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাসের মাঝে কখনো কখনো আওয়ামী লীগকে এই আত্মঘাতী পথ বেছে নিতে দেখা যায়। নীরদ সি. চৌধুরী আওয়ামী লীগ সম্পর্কে লেখেন নি, কিন্তু তিনি লিখেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’! এটি কী তারই একটি জ্বলন্ত অথচ কলঙ্কিত উদাহরণ!?

 এসবই কলঙ্কিত ইতিহাসের অংশ! অন্যদিকে ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্টের রাতের শেষ প্রহরের নারকীয় হত্যাকান্ড এবং ২০০৪-এর তৃতীয় সপ্তাহের আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড হামলার দ্বারা আক্রমনের মাধ্যমে বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে ‘বেনিফিশিয়ারিদের’ এবং ‘পরিকল্পনাকারীদের’ প্রতিবাদের নামে আস্ফালনের নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার উপযুক্ত সময়ও এই মাস! গণতন্ত্রের নামে কত কী যে আমাদের দেখতে ও শুনতে হচ্ছে তা আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা একেবারেই অসম্ভব! এই বছরের (২০২৩ সালের) জুন মাসে কানাডার আদালত পঞ্চম বারের মত বিএনপি-কে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এই খবর বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিএনপি-র পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রুহুল কবীর রিজভি সাহেবরা এর রুটিন প্রতিবাদ করেছেন। কানাডার আদালতে বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করার ঘটনাটি ২০২৩ এর জুন মাসে হলেও বাংলাদেশে এই সম্পর্কিত আলোচনা ২০২৩এর জুলাই মাসের শেষ থেকে শুরু করে শোকের মাস আগস্টেও অব্যাহত আছে। 

*অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 


অরুণ কুমার গোস্বামী আদালত কানাডা

খবরটি শেয়ার করুন