সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাশ্মিরে ফের অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা পাকিস্তান, চীন ও তুরস্কের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০২:৪৯ অপরাহ্ন, ১৫ই জুন ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

উজায় বুলুত :

গত ২২ ও ২৩ মে জম্মু ও কাশ্মিরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের রাজধানী শ্রীনগরে জি-২০ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ভারত। এতে ৬০ জন বিদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ১২২ জনের মতো প্রতিনিধিরা অংশ নেন। যদিও পাকিস্তান এবং তার দীর্ঘদিনের বন্ধু চীন ও তুরস্ক এই সম্মেলন বয়কট করে।

পাকিস্তান এ সম্মেলনকে অবৈধ বলেও জানায়। ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই জম্মু ও কাশ্মিরকে অনেক বছর ধরেই পাকিস্তান দাবি করছে, এমনকি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও চালাচ্ছে।

তিনটি জি-২০ সদস্য দেশ (চীন, সৌদি আরব এবং তুরস্ক) এবং ভারত কর্তৃক আমন্ত্রিত দুইটি অতিথি দেশ (মিশর এবং ওমান) এ সম্মেলনে কোনও প্রতিনিধি প্রেরণ করেনি। তবে ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং বাংলাদেশ, এ তিনটি মুসলিম দেশ সম্মেলনে অংশ নেয়।

সম্মেলনে ভারত এ অঞ্চলে তার উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি এ অঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনা সম্পর্কেও আলোচনা করে। কিন্তু এ সম্মেলনে বাধা সৃষ্টি করতে অনেক চেষ্টা করেছে পাকিস্তান।

মে মাসের শুরু থেকেই পাকিস্তান সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উক্ত সম্মেলনে বাধা প্রদান করতে অবিরাম প্রচেষ্টা চালায়। জম্মু অঞ্চলের পুঞ্চ সীমান্তে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে টহল দেয় এবং আঞ্চলিক শান্তির ক্ষেত্রে হুমকির সৃষ্টি করে।

তাছাড়া পুঞ্চে সন্ত্রাসী হামলাও চালানো হয়। এ ঘটনায় পাঁচজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছেন। একজন সন্ত্রাসীকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে এবং বাকিদেরকেও আটক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে হাজার হাজার বছর ধরে কাশ্মিরে হিন্দু ও বৌদ্ধরা বসবাস করছিলেন। চতুর্দশ শতকে মধ্য এশিয়া থেকে এসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী আক্রমণকারীরা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়। তখনও এ অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে ছিল। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার মতোই এখানকার অমুসলিম জনগণের অবস্থা হয়। নিজেদের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ইসলামি সশস্ত্র বাহিনিরা অমুসলিম জনগণদের উপর অত্যাচার শুরু করে, যার ফলে অনেক নাগরিক মারা যায় এবং অনেকে এ অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যারা পালিয়ে যেতে পারেননি তাদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়।

এ ব্যাপারে হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন বলেছে, পূর্বে কাশ্মির হিন্দু ও বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। ১৩৩৯ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চল হিন্দু রাজাদের দ্বারা শাসিত হতো। কাশ্মির উপত্যকার আদিবাসী হিন্দুরা কাশ্মিরি পণ্ডিত নামে পরিচিত। তারা এখানকার আদি বাসিন্দা এবং তাদের অনন্য জাতি-ধর্মীয় সংস্কৃতি রয়েছে যা প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরনো।

ইসলামিক আগ্রাসনের পর, ১৮১৯ সাল পর্যন্ত অসংখ্য বিদেশি বংশোদ্ভূত মুসলিম শাসকেরা কাশ্মির দখল করে। মুসলিম শাসনের অধীনে হিন্দুরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়৷ শিখরা ১৮১৯ সালে এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করে, তারপরে হিন্দু ডোগরা (রাজ্যের জম্মু অঞ্চলের একটি জাতিগত গোষ্ঠী) ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে রাজত্ব করে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশে বিভক্ত করলে কাশ্মিরের কাছে সুযোগ যায় যেকোন একটি দেশকে চয়ন করার। তখন পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনি কাশ্মিরে অতর্কিত হামলা চালায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মিরের ডোগরা রাজা হরি সিং দ্বারা শাসিত কাশ্মির রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়।

২০১৯ সালে, ভারত সরকার ভারতের সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে, জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে (ইউটি) বিভক্ত করে। একটি জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ এবং অন্যটি লাদাখ। পাকিস্তান ও চীন কাশ্মীরের অন্যান্য অংশ দখল করে আছে। 

জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান জনসংখ্যা ১২০ লাখেরও বেশি এবং লাদাখের ২৭ লাখের বেশি। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের (গিলগিট-বালতিস্তান সহ) আনুমানিক জনসংখ্যা ৬০ লাখ। হত্যা এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরের কারণে, পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে কোনও হিন্দু অবশিষ্ট নেই, যদিও এটি এখনও প্রাচীন হিন্দুদের পবিত্র স্থানগুলোর আবাসস্থল।

১৯৮৯-১৯৯০ সালে কাশ্মির উপত্যকায় বসবাসরত হিন্দুদের নির্মূলের অভিযান চালায় পাকিস্তান। এ অভিযানের মাধ্যমে হিন্দু বিরোধী সহিংসতার সমাপ্তি ঘটে।

এ অভিযানে হাজার হাজার হিন্দুদের হত্যা করা হয়, ৩০ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর, দোকানপাট, উপসনালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয় নয়তো জোরপূর্বক দখল করা হয়। প্রায় ৩৫০,০০০ হিন্দুকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক এ অঞ্চল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারা এখন পর্যন্ত তাদের বাসস্থানে ফিরে যেতে পারে নি।

১৯৯৮ সালের নভেম্বরে, কাশ্মীরি সমিতির সভাপতি শ্রী সি এল গাডু, কাশ্মীর ইস্যুতে লন্ডনের ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সে একটি বক্তৃতা দেন, যেখানে পাকিস্তান সমর্থিত মুসলিম চরমপন্থার ফলে আদিবাসী হিন্দুদের জনসংখ্যা হ্রাসের কথা তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি জানান, কাশ্মিরি পণ্ডিতেরা বর্তমানে পাকিস্তানের নৃশংসতায় সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হয়েছে। তাদের নীতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়েছে বারবার।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে পূর্বেও তাদের উপর হামলা চালানো হয়েছে। ১৯৪৭ সালে আদমশুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ছিল ১৫%, ১৯৮১ সালে ৫% এবং ১৯৯১ সালে ০.১%। এখানে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষদেরকেই এ অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রায় ৩৫০,০০০ কাশ্মিরি পণ্ডিতেরা কাশ্মির ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় এবং জম্মু ও দিল্লির শিবিরে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করে। 

সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দ্বারা কাশ্মির পণ্ডিতদের নির্মূল করার এ প্রচেষ্টার কারণে সম্প্রদায়টি আজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিধ্বস্ত এবং বিচ্ছিন্ন।

২০১৯ সালে ভারত সরকার দ্বারা ৩৭০/৩৫এ ধারা বাতিল করার লক্ষ্য ছিল ৩০ বছরেরও বেশি আগে জাতিগতভাবে নির্মূল হওয়ার পর বাস্তুচ্যুত কাশ্মিরি পণ্ডিতদের তাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমি কাশ্মীরে পুনর্বাসনের শর্ত তৈরি করা।

অন্যদিকে পাকিস্তান বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেএম), হারাকাত-উল-মুজাহিদিন (এইচএম), এবং হিজব-ইল-মুজাহিদিন (এইচএম) সহ বেশ কয়েকটি পাকিস্তান-ভিত্তিক চরমপন্থী গোষ্ঠী জম্মু ও কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে।

লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) হল একটি সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী যা ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে পাকিস্তানের লাহোরের কাছে অবস্থিত। এলইটি জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় সার্বভৌমত্বকে খণ্ডন করতে চায় এবং একইসাথে ভারতের কিছু অংশে এবং পাকিস্তানের পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামিক শাসন প্রসারিত করতে চায়। এটি কাশ্মির, চেচনিয়া এবং মধ্য এশিয়ার অন্যান্য অংশে সক্রিয়। এলইটি নেতা হাফিজ মুহাম্মদ সাইদ বলেছেন যে তিনি ভারত, ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রধান শত্রু বলে মনে করেন।

তবে কাশ্মিরের অনেক মধ্যপন্থী মুসলমান আজও হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিমদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য লড়াই করছে।

দ্য রিয়েল কাশ্মির নিউজের প্রধান সম্পাদক এবং অল জম্মু ও কাশ্মির ইয়ুথ সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ানা মীর এ বিষয়ে বলেন, ভারত সরকার কাশ্মিরকে আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে বাধা দিতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। আফগানিস্তানে নারীদের বিয়ে করার সময় মত প্রকাশের কোন অধিকার নেই এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সেখানে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হত্যা করা হয়। তাছাড়া ভারত সরকার কাশ্মিরকে আরেকটি পাকিস্তান হতেও দেননি। পাকিস্তানে মেয়েদের জোরপূর্বক বয়স্ক লোকেদের সাথে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয় এবং মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায় যেমন সুন্নি, শিয়া, আহমদীয়া একে অপরের উপর হামলা চালায়।

জিহাদ একটি বিশ্বব্যাপী হুমকি যা সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করেছে। এই অঞ্চল এবং তার বাইরের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য, জিহাদকে সফল হতে না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই কাশ্মির অঞ্চলে জি-২০ এর মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনের ফলে ভারত সরকার অন্যান্যদের কাশ্মিরের পর্যটন সম্পর্কে জানায়। তাছাড়া এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। 

যে দেশগুলো কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ এবং পর্যটন প্রচারের জন্য আয়োজিত জি-২০ এর এমন একটি সম্মেলনকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে, তারা কাশ্মিরের ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কাজ করছে।

আরো পড়ুন: হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানে ‘টপলেস’ হওয়ায় নিষিদ্ধ হলেন তিন অতিথি (ভিডিও)

তাদের লক্ষ্য, বরং, কাশ্মীরে একটি ইসলামবাদী রাষ্ট্র তৈরি করা যেখানে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং মধ্যপন্থী মুসলমানদের নির্যাতন করা হবে।

এ জাতীয় রাষ্ট্র বিস্তৃত অঞ্চলে সন্ত্রাস ও অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রও হবে। চীন, তুরস্ক এবং পাকিস্তানের মতো অত্যাচারী রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কাশ্মীরে ভারতের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করা উচিত সকলের।

উজায় বুলুত (তুর্কি সাংবাদিক)

সূত্র: গেইটস্টোন ইন্সটিটিউট

এম এইচ ডি/আইকেজে 

মুসলমান ইসলাম হিন্দু বৌদ্ধ জি-২০ সম্মেলন চীন তুরস্ক পাকিস্তান জম্মু কাশ্মির

খবরটি শেয়ার করুন