শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চীনা ঋণফাঁদে জর্জরিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১২:১৩ অপরাহ্ন, ২০শে মে ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন এবং কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের চাপে ধ্বংসের মুখে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ দেশই বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা রাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

পাকিস্তান, কেনিয়া, জাম্বিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়াসহ চীনের কাছ থেকে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় উচ্চ মাত্রার ঋণ পরিশোধ করে দেশের স্কুলসমূহ চালানো, বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখা কিংবা প্রয়োজনীয় খাদ্য ও জ্বালানির ব্যবস্থা করা প্রতিটি দেশের জন্যেই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে করতে এদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও প্রায় শেষের দিকে।

অন্যদিকে ঋণ মাফ করতে চীনের অনীহা এবং কত টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে ও ঋণ প্রদানের শর্তসমূহ নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করার কারণে অন্যান্য ঋণদাতারাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার সাহস করেন না।

দেশগুলো তাদের বৈদেশিক ঋণের ৫০% ই চীনের কাছ থেকে নিয়েছেন। বেশিরভাগ দেশই ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারি রাজস্বের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ইতিমধ্যেই খরচ করেছেন। এদের মধ্যে জাম্বিয়া এবং শ্রীলঙ্কা ঋণ খেলাপির দায়ে অভিযুক্ত।

বৈদেশিক ঋণের চাপে অধিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মেশিন চালানোর সামর্থ্য না থাকায় পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ টেক্সটাইল শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে। কেনিয়ায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য হাজার হাজার সিভিল সার্ভিস কর্মীদের বেতন আটকে রাখা হয়েছে। 

এক বছর আগে শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। সেখানে মুদ্রাস্ফীতি ৫০% ছাড়িয়ে গেছে এবং দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি চরম দারিদ্র‍্যের কবলে পড়েছেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, চীন যদি দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়, তবে আরও অনেক দেশই অদূর ভবিষ্যতে দেউলিয়া ঘোষিত হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জাম্বিয়া গত বিশ বছর ধরে বাঁধ, রেলপথ এবং রাস্তা নির্মাণের জন্য চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ধার নিয়েছে। ঋণ জাম্বিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করলেও বৈদেশিক ঋণের সুদের চাপে বর্তমানে দেশটি বিপর্যস্ত। 

এমন পরিস্থিতিতে পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রগুলো ঋণ মওকুফের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও চীন কোনও ধরনের সহানুভূতিশীল আচরণ দেখাতে নারাজ। এমতাবস্থায় চীন তার গোপনীয়তাকে গুরুত্ব প্রদান করে জাম্বিয়ার সাথে আলোচনায় বসতেও রাজি হয়নি। ফলে অন্যান্য ঋণদাতারাও জাম্বিয়ার সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। ২০২০ সালে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণ খেলাপির দায়ে অভিযুক্ত হয় জাম্বিয়া।

জাম্বিয়াতে মুদ্রাস্ফীতি ৫০% বেড়েছে। ১৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটিতে। তাছাড়া জাতিসংঘের ধারণা মতে দেশটির প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবারটুকুও পাচ্ছে না। জানা যায়, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কাছে ৬৬ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ রয়েছে জাম্বিয়ার, যা তার মোট ঋণের প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের অনুরোধ সত্ত্বেও ঋণ মাফ করতে নারাজ চীন। দেখা যাচ্ছে, চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহীতা রাষ্ট্রগুলোর এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের পরিমাণ ৫০% এরও বেশি কমেছে। মঙ্গোলিয়ায় আট মাসের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার তার চেয়েও কম, মাত্র দুই মাস।

পাকিস্তানের টেক্সটাইল কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকেরা চরম দারিদ্র‍্যের মুখে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যার কথা ভাবছেন। এর আগেও অনেক দেশ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বের বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও এমন পরিস্থিতির শিকার হয় নি।

সরকারি অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব মিলিয়ে সারাবিশ্বে খাদ্যশস্য ও তেলের দাম বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মার্চ মাসে, ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত হন্ডুরাস চীনের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তে নেয়। এর পেছনেও দেশটির আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

গত মাসে, পাকিস্তান তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে রাশিয়ার সাথে তেলক্রয়ের চুক্তি স্থাপন করে। শ্রীলঙ্কায়, দাঙ্গাকারীরা গত জুলাই মাসে রাস্তায় নেমে আসে এবং সরকারী মন্ত্রীদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। চীনের কাছ ঋণ গ্রহণ করেছিলেন যে রাষ্ট্রপতি, তিনি প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

এ ব্যাপারে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীন কখনোই ঋণ মাফ করে আসছে না, তাই এবারেও এ বিষয়ে দেশটি কোন সহানুভূতি প্রদর্শন করবে না। বিভিন্ন দেশের বিপদের সময় ঋণ প্রদান করে দেশগুলোকে সাহায্য করেছে চীন। তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সাহায্য সে ইতিমধ্যেই করেছে।

আরো পড়ুন: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন

তবে এতকিছুর মধ্যেও একটি সুখবর হলো যে, গত বুধবার আইএমএফ ঘানার জন্য ৩০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞদের দাবি, চীনের নিজের অর্থনীতি বর্তমানে ক্ষতির সম্মুখীন। দেশটি নিজের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কাজ করে চলেছে। এ অবস্থায় যেকোনও ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া দেশটির পক্ষে আদৌ সমীচীন নয়। আর তাই দেশটি ঋণ মওকুফের ক্ষেত্রে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করছে।

তবে চীন এমন অনেক দেশকে গোপনে ঋণ প্রদান করেছে যার হিসাব সরকারিভাবে দেশটি দেয় নি। যেমন, জলবিদ্যুৎ নির্মাণের জন্য জাম্বিয়াকে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে চীন, যার হিসাব সরকারি খাতায় নেই। আবার রেলপথ নির্মাণে সহযোগিতার জন্য ইন্দোনেশিয়াকে ৪০ কোটি ডলার প্রদান করে চীন, যার হিসাবও সরকারিভাবে দেশটি প্রদান করে নি।

এমএইচডি/ আই. কে. জে/

চীনা ঋণ ফাঁদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বিশ্বব্যাংক

খবরটি শেয়ার করুন