সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জন্মের ৩৫ বছর পর বাবার স্পর্শ, চোখ ভিজেছে সবার

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন, ২৫শে অক্টোবর ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

বরিশালের বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামের আব্দুল জব্বার। ভাগ্য বদলের আশায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বাড়ি রেখে পাড়ি জমান প্রবাসে। ভেবেছিলেন ইরানে যাবেন। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে প্রথমে ভারত এবং পরে পাকিস্তানে ঢুকেন তিনি। 

কিন্তু সেখান থেকে ইরানের উদ্দেশে আর বের হতে পারেননি। এরপর পাকিস্তানেই কেটে গেছে একে একে ৩৫টি বছর। পরিবারের সবাই ভেবেছিল মানুষটিকে বোধহয় আর ফিরে পাবেন না। তবুও যেন আশায় বুক বাধা। সঙ্গে সবচেষ্টা চালিয়ে গেছেন স্বজনরা।

অবশেষে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে ৩৫ বছর ধরে নিখোঁজ থাকা জব্বার ফিরে এলেন স্বজনদের কাছে।

শুক্রবার (২০ অক্টোবর) রাতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে দেশে ফিরেন তিনি। এসময় বিমানবন্দরের পাশে আশকোনায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। যেই সন্তান অন্তঃসত্বা রেখে গিয়েছিলেন সেই সন্তান ৩৫ বছরের যুবকে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ এই অপেক্ষার পর বাবাকে প্রথমবার ছুঁয়ে দেখার আনন্দ দেখে চোখ ভিজেছে সেখানকার সবারই।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান এই বিষয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে জানান, এভাবেও ফিরে আসা যায়! হারিয়ে যাবার ৩৫ বছর পর এক বাবা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরছেন, স্বামীকে পেয়ে কাঁদছেন স্ত্রী। এই আনন্দ ফিরে পাবার‌। এই আনন্দ পুনর্মিলনীর! এমন ঘটনাগুলো দেখলে চোখ ভিজে যায়! আসলে বাস্তব সিনেমার চেয়েও সুন্দর! কিন্তু একেকটা সুন্দরের পেছনে কতো বেদনা, কতো যে অপেক্ষা থাকে! এই যেমন আজকের সুন্দরের পেছনে ৩৫ বছরের অপেক্ষা! আসলে আমাদের মাইগ্রেশন টিমের একদল কর্মী যেসব অসাধারণ কাজ করে তার প্রত্যেকটাই একেকটা সিনেমা হতে পারে। এই যেমন বরিশালের আবদুল জব্বার। 

তিনি জানান, ভাগ্য বদলাবে এমন আশায় বিদেশে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন এই আবদুল জব্বার। ৩৫ বছর আগে দালালরা তাকে নেয় ভারতে। এরপর পাকিস্তান হয়ে ইরান। কিন্তু পাকিস্তানেই আটকা পড়েন তিনি। ছয় মাস পর আবদুল জব্বার পরিবারের কাছে একটা চিঠি পাঠান তিনি ভয়াবহ বিপদে আছেন। এরপর আর কোন খোঁজ নেই। পরিবার জানে না বেঁচে আছে না মরে গেছে। মাঝখানে কেটে যায় ৩৫ বছর। এরপর পাকিস্তান থেকে তাদের এক আত্মীয়ের ঠিকানায় হঠাৎ এক চিঠি। 

আবদুল জব্বার যখন বিদেশে যান তখন তার বড় ছেলে আবুল হোসেনের বয়স তিন, কন্যা নুপুরের বয়স দুই আর ছোট্ট সন্তান কামাল তখনো পৃথিবীতে আসেনি। স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা রেখেই বিদেশে যান তিনি। বাবা বিদেশে যাওয়ার তিনমাস পর পৃথিবীতে জন্ম কামালের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তরে কামাল কখনো বাবাকে দেখেননি। বাবার স্পর্শ পাননি। এখানে ওখানে খোঁজ করেও বাবার কোনো সন্ধান পাননি। 

৩৫ বছর পর হঠাৎ আসা ওই চিঠির সূত্র ধরে পাকিস্তানের বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপে পোস্ট দেন। চিঠির ঠিকানায় গিয়ে তার বাবার খোঁজ করতে বলেন। একজন ডাক্তার তাতে সাড়া দেন। তিনি ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে জানান কামালের বাবা সেখানে বেঁচে আছে। ঠিক ওই সময়ে গণমাধ্যমে একটা নিউজ দেখেন কামাল যে ব্র্যাকের সহায়তায় ২৫ বছর পর সৌদি আরব প্রবাসী আবুল কাশেমের সন্ধান পেয়েছে তাঁর সন্তানেরা। নতুন আশায় কামাল যোগযোগ করেন ব্র্যাকে।

ব্র্যাকের কারো নম্বর ছিলো না কামালের। ফলে কামাল ব্র্যাকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে মেসেজ দিয়ে জানান তার বাবা পাকিস্তানে আটকা ৩৫ বছর ধরে। আসলে কাশেম চাচার ঘটনার পর সারা দেশ থেকে এমন একাধিক ঘটনার খোঁজ পাই আমরা। প্রত্যেকেটা নিয়েই কাজ করছিলাম। এর মধ্যে আমাদের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কমিউনিকেশন ম্যানেজার আয়মান আপা আমাদের পাকিস্তানে আবদুল জব্বার মানে কামালের বাবার ঘটনা জানান। 

কামাল জানাচ্ছিলেন, প্রায় ৩৫ বছর আগে তার বাবা বিদেশে গেছেন। বাবাকে তিনি কখনো চোখে দেখেননি। যদি তার বাবাকে আমরা খুঁজে দিতে পারি! ভীষণ করুণ সেই আকুতি! কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাকিস্তান মানে অতিরিক্ত জটিলতা। তাও একজন আবার ৩৫ বছর ধরে সেখানে আটকে আছেন! বেশ স্পর্শকতার বিষয়। বিস্তারিত সব তথ্য জানলাম আমরা। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম বৈধ কোন কাগজপত্র নেই বলে ৩৫ বছরে ধরে পাকিস্তানে আটকা আবদুল জব্বার। সব তথ্য নিয়ে আমরা যোগাযোগ করি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবেদন করা হয় ফিরিয়ে আনার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তান দূতাবাসে যোগাযোগ করে। শুরু হয়ে অপেক্ষার পালা!

এরপর পাকিস্তান থেকে পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি আসে আবদুল জব্বাররের পরিচয় নিশ্চিত করতে। পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে চিঠি গেল পাকিস্তানে। কাটলো আরো কয়েক মাস! অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গতকাল রাতে দেশে ফিরলেন জব্বার! পরিবারের দীর্ঘ ৩৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসানে জন্ম নিলো নতুন এক সুখের!

ওআ/

বাবা আনন্দ

খবরটি শেয়ার করুন