শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ড. ইউনূসের দুদকে হাজিরা

অরুণ কুমার গোস্বামী

🕒 প্রকাশ: ১২:৫০ পূর্বাহ্ন, ৮ই অক্টোবর ২০২৩

#

গ্রামীণ টেলিকমের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতে বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর, ২০২৩) সকাল পৌনে ১০টার দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানের সময় দুর্নীতির মাধ্যমে শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে গত ৩০ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের আট পরিচালক, তিন শ্রমিক নেতা এবং শ্রমিকদের দুই আইনজীবীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যানসহ বোর্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ’ করে পরস্পর যোগসাজশে ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। আগের দিন (৪ অক্টোবর, ২০২৩) একই মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠানটির তিন পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তারা হলেন, নাজনীন সুলতানা, নূরজাহান বেগম ও হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী।

ড. ইউনূস এবং তার সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তদন্ত নতুন নয়। বিগত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১-এ, শ্রমআইন লঙ্ঘনের জন্য ড. ইউনূস এবং অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ কর্তৃক শ্রম আইনের ধারা ৪, ৭, ৮, ১১৭ এবং ২৩৪ এর অধীনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের শ্রমআইন লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন যে, তার প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শ্রমআইন ভঙ্গ করেছে।

৩০ মে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর থেকে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বিবৃতি প্রদান করেছেন দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ড. ইউনূসকে দুদকে তলব করার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমে দাবি করেছেন হয়রানি করার জন্যই ড. ইউনূসসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্ত কিংবা বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এই ধরনের বিবৃতি প্রদান কতটা আইনসম্মত সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। অপরদিকে, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করেন ড. ইউনূসকে। তবে তিনি সেসব প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এটা একটা আইনি বিষয়। আমার আইনজীবীই সব বলবেন। আপনারা (সাংবাদিক) এসেছেন, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ এরপরই তিনি দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন। দুদক কার্যালয়ে ড. ইউনূসের জিজ্ঞাবাদের পাশাপাশি জনমনে এটিও একটা জিজ্ঞাসার বিষয় যে দুদক কেন মামলা দায়ের করেছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে, কী ছিল মামলার প্রেক্ষাপট, কী অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

উল্লেখ্য, এর আগে এ বছরের ৩১ মে দানের বিপরীতে ধার্য করা প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা আয়কর চেয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাঠানো নোটিশ বৈধ মর্মে রায় ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ড. ইউনূসের করা পৃথক তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। ফলে তাকে আয়করের প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রাধীন গ্রামীণ টেলিকম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের ৩৪.২% শেয়ারের মালিক। গ্রামীণফোন থেকে প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকা মুনাফা পেয়ে থাকে গ্রামীণ টেলিকম। শ্রমআইন ২০০৬ অনুযায়ী যে কোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীগণ প্রতিষ্ঠানটির মোট মুনাফার ৫% লভ্যাংশ পাওয়ার কথা থাকলেও গ্রামীণ টেলিকম নিজেদের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দাবি করে শ্রমিক-কর্মচারীদের কোনও লভ্যাংশ প্রদান করত না। লভ্যাংশ প্রাপ্তির দাবি নিয়ে ২০১৭ সালে ২৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীকালে আরো শ্রমিক-কর্মচারী মামলা দায়ের করলে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। মামলা দায়ের সত্ত্বেও লভ্যাংশ প্রদান না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে গ্রামীণ টেলিকম। উপরন্তু, ২০২০ সালে কোভিড মহামারী চলাকালীন এক নোটিশে গ্রামীণ টেলিকমের ৯৯ জন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করে গ্রামীণ টেলিকম। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চাকুরি ফিরে পায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীরা।

লভ্যাংশ প্রাপ্তির মামলাসমূহে আইনি প্রতিকার না পেয়ে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘গ্রামীণ টেলিকম’ কোম্পানির অবসায়ন চেয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের পক্ষ হতে রিট পিটিশন দাখিল করা হয় উচ্চ আদালতে। উক্ত রিট পিটিশনে ড. ইউনূস এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা, গ্রামীণ টেলিকমের শত শত কোটি টাকা অন্যত্র স্থানান্তর, লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের মাধ্যমে আদালতকে প্রভাবিত করে চলমান মামলাসমূহের রায় নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের পূর্বক কোম্পানিটির অবসায়ন ঘটিয়ে কর্মচারীদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। 

উক্ত রিট পিটিশনটি আদালত কর্তৃক মামলা হিসেবে গৃহীত হলে গ্রামীণ টেলিকম তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার এবং বাধ্যতামূলক অবসরে যাবার শর্তে শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানে সম্মত হয়। এটি সহজেই অনুমেয় যে, গ্রামীণ টেলিকম যদি নিজেদের অবস্থানে আইনিভাবে এবং নীতিগতভাবে সঠিক হতো তাহলে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানে রাজি হত না। বরং আদালতের বিচারের মাধ্যমেই এর সুরাহা করত। তা না করে লভ্যাংশ প্রদানে রাজি হওয়াই প্রমাণ করে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জেনেশুনে কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিলেন। 

লভ্যাংশ প্রদানের জন্য গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মাঝে ২৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে একটি ‘সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। ৯ মে, ২০২২ তারিখে ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের ১০৮তম পরিচালনা পরিষদের সভায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের ৪৩৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরিচালনা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ মে, ২০২২ তারিখে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় গ্রামীণ টেলিকম নামে একটি পৃথক একাউন্ট খোলা হয় এবং তাদের ৪৩৭ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকম হতে স্থানান্তর করা হয়।

এই টাকার পুরােটাই শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ হিসেবে পাবার কথা থাকলেও তাদের লভ্যাংশ প্রদান শুরুর পূর্বেই উক্ত একাউন্ট সরিয়ে নেয়া হয়। উক্ত অর্থ হতে ‘গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন’ নামীয় পৃথক একটি একাউন্টে সরিয়ে নেয়া হয়। উক্ত অর্থ হতে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের তিন নেতা মো. কামরুজ্জামান, ফিরোজ মাহমুদ হাসান এবং মো. মাইনুল ইসলাম প্রত্যেকে ৩ কোটি টাকা করে গ্রহণ করেন। এছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারীদের আইনজীবী এডভোকেট ইউসুফ আলী এবং এডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফকে দেয়া হয় সর্বমোট ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশের অর্থ হতে গ্রামীণ টেলিকম তাদের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিন শ্রমিক নেতা ও দুই আইনজীবীকে ২৫ কোটি টাকা বেআইনিভাবে প্রদান করে। মূলত এই অপরাধেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়: প্রথমত, শ্রমিক কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রমআইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট বিধি বিধান রয়েছে। এর জন্য পৃথক কোন ‘সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টে’র প্রয়োজন নেই। তাহলে গ্রামীণ টেলিকম কেন শ্রমিক-কর্মচারীদের সাথে পৃথক ‘সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট’ করতে গেল? আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিলেই তো হতো। অর্থাৎ এই সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টটি করাই হয়েছে শ্রমিক নেতা এবং আইনজীবীদের অবৈধ সুবিধা প্রদানের জন্য এবং তা পরিচালনা পরিষদ তথা ড. ইউনূসের প্রত্যক্ষ নির্দেশনাতেই হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ টেলিকম কেন শ্রমিক-কর্মচারীদের আইনজীবীদের আইনী ফি প্রদান করলো? কখনো কী কেউ শুনেছেন যে বিবাদী পক্ষ বাদী পক্ষের আইনজীবীদের খরচ বহন করে? গ্রামীণ টেলিকম তার শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার পর শ্রমিক কর্মচারীরাই তো আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করতে পারত। কিন্তু তা না করে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিকদের দুই আইনজীবীকে ১৬ কোটি টাকা প্রদান করল? বিস্ময়কর ব্যাপার হলো উক্ত ১৬ কোটি টাকার মাত্র এক কোটি টাকা জমা হয়েছে আইনজীবীদের ল’ফার্মের একাউন্টে ‘আইনজীবী ফি’ হিসেবে। বাকি ১৫ কোটি টাকা দুই আইনজীবী ভিন্ন ভিন্ন একাউন্টে সরিয়ে নেন। ৬ কোটি টাকা দিয়ে তারা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে একটি যৌথ হিসাব খোলেন যেখানে তাদের পরিচয় দেয়া হয় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামক একটি এনজিওর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। তারা যদি আইনসঙ্গত ভাবেই ফি পেয়ে থাকেন তাহলে কেন তারা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে একাউন্ট খুলে সেই টাকা স্থানান্তর করলো। কী করা হতো এই টাকা দিয়ে?

তৃতীয়ত, তিন শ্রমিক-কর্মচারীকে গ্রামীণ টেলিকম কেন তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশের অতিরিক্ত ৯ কোটি টাকা প্রদান করলো? আইন অনুযায়ী বাকি শ্রমিকদের মতো তারাও তো তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশ পেয়েছে। কিন্তু তার বাইরে এই অতিরিক্ত টাকা কেন দেয়া হলো তাদের? যেখানে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছে তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেখানে কেন সমঝোতার মাধ্যমে কিংবা কিসের কারণে এই আইনজীবী ও শ্রমিক নেতাদের প্রায় ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত দেয়া হলো?

দুদকের তদন্ত এবং আদালতের বিচারে এই সকল প্রশ্নের উত্তরই আমরা পাব আশা করি। তবে, এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পরিষদ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। তিন শ্রমিক নেতা ও দুই আইনজীবীর সাথে যোগসাজশে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত করেছেন। উনার আইনজীবী যতোই উনাকে নির্দোষ দাবি করুন না কেন, সচেতন যেকোন ব্যক্তি একটু খোঁজ খবর নিলেই জানতে পারবেন প্রকৃত সত্যটা কী? 

*অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 


মামলা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অরুণ কুমার গোস্বামী দুদক সচিব

খবরটি শেয়ার করুন