সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্মীয় নয়, জমির অধিকার নিয়ে মণিপুরে সহিংসতা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:০৪ অপরাহ্ন, ২৫শে জুলাই ২০২৩

#

ভারতের মণিপুর রাজ্যে জমির অধিকার নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। মণিপুরের সহিংসতার ভিডিও হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে মিয়ানমার ও ফ্রান্সের বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবি। এদিকে মণিপুরের সহিংসতাকে পাকিস্তান ধর্মীয় সহিংসতা হিসাবে প্রচার করছে। 

জানা যায়, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মণিপুরকে ভারতের রত্ন বলে অভিহিত করেন। নয়টি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এ মণিপুর। সুভাষ চন্দ্র বসু এবং তার আজাদ হিন্দ ফৌজেরও ইতিহাস জড়িয়ে আছে মণিপুরের সাথে। মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার মইরাং এলাকাই সর্বপ্রথম শত্রুমুক্ত হয়৷ সুভাষ চন্দ্র বসুর সেনাবাহিনী আইএনএ মুখোমুখি লড়াইয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সমগ্র এলাকা মুক্ত করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল শওকত মালিক মইরাং এলাকায় ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।

মণিপুরের প্রধান প্রধান সামাজিক গোষ্ঠী হলো মৈতি, কুকি এবং নাগা। এর মাঝে মৈতি সংখ্যাগরিষ্ঠ, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ। কুকি ও নাগা সম্প্রদায়সহ আরো ৩৫টি উপজাতি রয়েছে এখানে। মৈতি সম্প্রদায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। ৬০ সদস্যের মণিপুর বিধানসভার ৪০ জন বিধায়কই মৈতি সম্প্রদায় থেকে এসেছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংও এই সম্প্রদায়ভুক্ত৷ বাকি ২০ জন বিধায়ক অন্য সম্প্রদায়ের।

মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৬০% ই ইম্ফল শহর ও এর আশেপাশের এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এই এলাকা সেন্ট্রাল ভ্যালি বা ইম্ফল ভ্যালি নামে পরিচিত। কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের লোকেরা ইম্ফল উপত্যকা সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় বাস করে। মণিপুরের ৯০ শতাংশ এলাকাই পাহাড়ি। 

মৈতি সম্প্রদায়ের লোকেরা সমতলে বাস করে।  মৈতি সম্প্রদায়ের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মৈতি পাঙ্গাল বলা হয়৷ মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। 

কুকি সম্প্রদায়ের মাঝেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের দেখা যায়৷ মূলত এ সম্প্রদায়ের অনেক পুরুষ পূর্বে বাঙালি মুসলিম মেয়েদের বিয়ে করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে যায়৷ তবে মণিপুরে কুকি মুসলমানদের তেমন একটা দেখা যায় না। 

সম্প্রতি মৈতি সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠে। এ সম্পর্কে মৈতি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মণিপুর হাইকোর্টে একটি পিটিশনও দায়ের করা হয়। 

এই পিটিশনে বলা হয়, ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে একীভূত হওয়ার আগে মৈতি সম্প্রদায়কে উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। পূর্বপুরুষদের ভূমি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষার জন্য মৈতি সম্প্রদায়ের উপজাতির মর্যাদা প্রয়োজন। এ বিষয়ে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল মণিপুর হাইকোর্ট তার সিদ্ধান্ত শুনায়। আদালত রাজ্য সরকারকে আদেশ প্রাপ্তির ৪ সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশ করার নির্দেশ প্রদান করে।

তবে হাইকোর্টের এ সিদ্ধান্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠে মণিপুরের পরিবেশ। কুকি ও নাগা উপজাতিরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। তাদের বক্তব্য হলো এমনিতেই মৈতি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া মৈতিরা উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেলে অন্যান্য উপজাতিদের কাজের সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি তারা পাহাড়েও জমি কেনা শুরু করবে, যা উপজাতিদের প্রান্তিকতার দিকে নিয়ে যাবে। এ সমস্ত বিতর্ক নিয়ে ৩ মে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুর একটি সমাবেশের আয়োজন করে। ইম্ফল থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে চুরাচাঁদপুরে আদিবাসী সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। 

সমাবেশ চলাকালীন উপজাতি এবং অন্যান্য দলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য স্থানেও। 

এ সহিংসতার মূল কারণ হলো ভূমি দখল। মৈতি সম্প্রদায়ের লোকেরা সমতলে বসবাস করে৷ অন্যদিকে কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের লোকেরা পাহাড়ি এলাকায় বাস করে। মণিপুরের আইন অনুযায়ী, শুধু উপজাতিরাই পাহাড়ি এলাকায় বাস করতে পারবে। সেজন্য এখন পর্যন্ত মৈতি সম্প্রদায়ের লোকেরা পাহাড়ি এলাকায় বাস করতে পারেনি। বিবিসির প্রতিবেদনেও এ সহিংসতার মূল কারণ বলা হয় জমির অধিকার। 

মণিপুরের সহিংসতার অন্যতম কারণ আফিম চাষ। বর্তমানে রাজ্য সরকার আফিম চাষকে দমন করতে চাইছে। কিন্তু এই আফিম চাষের সাথে জড়িত কুকি সম্প্রদায়ের লোকেরা। ২০১৭ সাল থেকে সরকার ১৮,৬০০ একরেরও বেশি পপি ক্ষেত ধ্বংস করেছে বলে জানা যায়। এ ক্ষেতগুলো মূলত ছিল কুকি সম্প্রদায়ের। 

তবে মণিপুরের সহিংসতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক ভিডিওতে দেখা যায় মণিপুরে পুলিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মহিলারা নগ্ন হয়ে পুলিশদের তাড়া করছেন। তবে এ ভিডিওটির সঙ্গে মণিপুরের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ভিডিওটি উত্তর প্রদেশের নাগরিক নির্বাচনের সময়কার যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী সোনু কিন্নরের সমর্থকরা চান্দৌলি জেলায় পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করে তোলপাড় সৃষ্টি করে।

মণিপুরে ৩০০ বছরের পুরনো একটি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়ার দাবি করে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। তবে ভিডিওটি মূলত মণিপুরের নয়, ফ্রান্সের সহিংসতার সময়কার। অপর এক ভিডিওতে এক খ্রিস্টান মহিলাকে নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করায় খুনের শিকার হতে দেখা যায়। তবে এ ভিডিওটিও ভারতের নয়, বরং মিয়ানমারের। 

মণিপুরের সহিংসতাকে আবার পাকিস্তানিরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছে। তাদের মতে এ সহিংসতা খ্রিস্টানদের (কুকি, নাগা) উপর হিন্দুরা (মৈতি) করছে। যদিও এটি ধর্মীয় সহিংসতা নয়, বরং জমি ও অধিকারের লড়াই৷ পাকিস্তানিরা চতুরতার সাথে ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গাকে মণিপুর সহিংসতার সাথে জুড়ে দিচ্ছে। তবে মজার বিষয় হলো শিখ বিরোধী সহিংসতা হিসেবে তারা যে ছবিটি ব্যবহার করছে, তা মূলত শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময়কার।

ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল (আইএএমসি) সহিংসতাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছে। মৈতি জনগোষ্ঠীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কুকি নারীরা এ পরিপ্রেক্ষিতেও অনেকে অনেক টুইট বার্তা প্রদান করে।

খ্রিস্টান ও হিন্দুদের মাঝে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে চলমান সহিংসতাকে। মৈতি সম্প্রদায় রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে বলেও অনেকেই দাবি করেন। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং আল জাজিরাও এ সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে দাবি করে।

অবশেষে এটাই বলা যায়, মণিপুরের সহিংসতার মূল কারণ হলো ভূমি অধিকার। এ সহিংসতার পেছনে কোনও ধর্মীয় মতবিরোধ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনিতেই মণিপুর সম্পর্কিত অনেক ভুয়া তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবং পাকিস্তান ও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোও এ সহিংসতাকে খ্রিস্টান ও হিন্দুদের মধ্যকার সহিংসতা হিসেবে দাবি করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানিরাও ভারতকে বদনাম করার জন্য অনেক ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে।

আইকেজে /

মণিপুর সহিংসতা

খবরটি শেয়ার করুন