কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিলয় আকাশ
রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সাংগীতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। জোঁড়াসাকুর ঠাকুর বাড়িতে সমাগত হত তৎকালীন শাস্ত্রীয় প্রথিতযশা শিল্পীদের। পারিবারিকভাবে সংগীত শিক্ষার জন্য ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের সংগীত শিক্ষকদের নিয়োগ করতেন- তাঁদের মধ্য বিষ্ণু চক্রবর্তী, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, যদুভট্ট এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের নিকট বসে তালিম নিয়েছেন সে কথা বলা যায় না। তিনি যা শিখেছেন বা আত্মস্থ করেছেন তা বিক্ষিপ্তভাবে অন্যদেরকে শেখানোর সময় বাইরে থেকে শুনে শুনে গ্রহণ করেছেন।
তবে সংগীতকে তাঁর নিকট নিয়ে এসেছেন মূলত তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাকে তিনি সেজদা বলে ডাকতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিশেষ অনুরাগী ও যন্ত্র সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। পিয়ানো বাজিয়ে গানের সুর তুলতেন এবং ১৩ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথের উপর দায়িত্ব আরোপিত হয় সে সুরে কথা বসানোর। বলা চলে অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদেই সংগীতকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের হাতেখড়ি হয়।
ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের জন্য সংগীত রচনার তাগিদ থেকে ঈশ্বর ভাবনা প্রকাশে বেশ কিছু গান তিনি বাল্যকালেই রচনা করেছিলেন। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত রচিত এসব গানের বাণীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের কথা এসেছে। হৃদয়ের প্রশস্ত প্রান্তের অনুভব দ্বারা পরিণত বয়সে প্রকৃতিকে তিনি যেভাবে আস্বাদন করেছেন, সে উপলব্ধি তাঁর প্রথম জীবনের গানে জাগ্রত নেই। যেমন ১৩ বছর বয়সে রচিত একটি গান নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়-
‘গগণের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,
তারকা মণ্ডল চমকে মোতি রে
রূপ মলয়ানিল,পবণ চামর করে,
সকল বণরাজি ফুটন্ত জ্যাতিরে ।।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রকৃতিকে একই সাথে তাঁর রচনায় আবদ্ধ করেছেন। সুবিশাল আকাশকে থালা এবং চাঁদ, সূর্য, তারকা মণ্ডলকে এ থালার সুসজ্জিত উপকরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে এই গানটির ভাব ও বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অনুধাবন নয়। গানটি পাঞ্জাবের ধর্মগুরু ‘নানক শাহ’ এর গানের অনুবাদ।
‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ছোট বেলায় জানালা দিয়ে আকাশের রং বৈচিত্র্য কিংবা মেঘ ছুটে বেড়ানো বা ঝড়ের সময় গাছপালার আকস্মিক কর্মচ্ছলতা তাঁকে আকর্ষণ করত। তাঁর ভাবনায় স্থান পেলেও বালক রবীন্দ্রনাথের গানে সেটির প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। বিলেতে যাওয়ার পরে সমুদ্র যাত্রার অভিজ্ঞতা কিংবা ইউরোপের ভিন্ন প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে পরিচয় ঘটলেও সেটিও তাঁর গানে তেমনভাবে আসেনি। বরং বিলেত থেকে ফেরার পর তিনি অপেরা এর আদর্শে গীতিনাট্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। এই সময়টিকে তাঁর রচনার শিশুকাল বা অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়কাল বলা যায়।
এরপর জমিদারি কাজ তদারকির জন্য তাঁর আগমন ঘটে পূর্ববঙ্গে। শিলাইদহ, শাহাজাদপুর, পতিসরে তিনি নৌকায় যাতায়াত করতেন। এ সময় গ্রামবাংলার রূপ, নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তিনি সমগ্র ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করেন। বলা চলে প্রকৃতি ও সবুজের সমারোহে নতুন করে পরিচয় ঘটে। তিনি এ বিষয়ে ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখেছেন-‘জলের শব্দ, দুপুর বেলাকার নিস্তব্ধতার ঝাঁ ঝাঁ, এবং ঝাউঝোপ থেকে দুটো-একটা পাখির চিকচিক শব্দ, সব শুদ্ধ মিলে একটা স্বপ্নময়ভাব।... খুব লিখে যেতে ইচ্ছে করছে-কিন্তু আর কিছু নয়, এই জলের শব্দ, এই রোদ্দুরের দিন, এই বালির চর। মনে হচ্ছে তোকে রোজই ঘুরে ফিরে এই কথাই লিখতে হবে- কেননা, আমার যখন নেশার মত হয় তখন আমি বারবার এই কথা নিয়েই বকি।’ চরণগুলিতে প্রকৃতিকে নিয়ে তাঁর আচ্ছন্নতার কথা বেশ দৃঢ়ভাবেই প্রকাশ পায়।
শান্তিদেব ঘোষের মতে পনের-ষোল বছর বয়স থেকে শুরু করে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যত গান রচনা করেছেন সেখানে প্রকৃতি পর্যায় বা ঋতুভিত্তিক গানের সংখ্যা খুবই সামান্য। এসময় কবি বসন্তের গান লিখেছেন মাত্র তিনটি, বর্ষার সাতটি, শরতের মাত্র একটি-মোট এগারটি।
তবে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ যে কেবল প্রকৃতি পর্যায়ে বা ঋতুভিত্তিক গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তা এখানে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। ৪৪ বছর বয়সে লেখা-‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’ গানটিতে তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন উদ্দীপনার সৃষ্টিতে। স্বদেশ পর্যায়ের গানটি বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত। ‘মন মাঝি সামাল সামাল’ নামক সারি গান থেকে সুর নেওয়া হলেও বাণীর মধ্যে যে ভাব প্রকাশিত হয়েছে তা নিজস্ব ভাবনা থেকে প্রসূত। দুর্যোগের সময় থেকে প্রতিবাদের ক্ষণ এসেছে, এবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে অন্যায় রুখতে সাড়া জাগানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং প্রকৃতি পর্যায়ভুক্ত না হয়েও প্রকৃতির অনুষঙ্গ তিনি স্বদেশ পর্যায়ের গানে ব্যবহার করতে শুরু করেন মধ্য বয়স থেকেই।
এই প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ করা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য সংগীতকার ও লেখকদের মধ্যেও তখন প্রকৃতি ভাবনার সঞ্চার দেখা যায়। এই সময়ে রজনীকান্ত সেনের গান-
‘ধীর সমীরে চঞ্চল নীড়ে
পাখি গাহে সুমধুর বোল
বিগলিত কাঞ্চন সন্নিভ শশোধর
জল মাঝে খেলে মৃদু দোল’
কিংবা ঈশ্বরকে আবদ্ধ করে লিখেছেন ‘তব পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক মোর-মোহ কালিমা ঘুচায়ে’। প্রকৃতিকে আশ্রয় করে নিবেদন করেছেন ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন -
‘একি মধুর ছন্দ মধুর গন্ধ’
‘পবন মন্দ মন্থরে’
কিংবা গানের চরণে জানিয়েছেন-
‘বিজলির মতো এসে সে
কোথা কোন মেঘে লুকালো’
অতুল প্রসাদ সেন লিখেছেন-
‘তুমিও একাকী আমিও একাকী
আজি এ বাদল রাতে
সহসা কে এলে গো
এ তরী বাইবে বলে’
সমসাময়িক গীতিকারদের প্রকৃতি নিয়ে সংযোজন ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি বিষয়ক অনুষঙ্গ সবাইকে ছাড়িয়ে যায় পরবর্তী জীবনে। পদ্মা পাড়ের উৎসার নিসর্গ জীবন তাঁর চিত্রে যে রসের সাগর অনাবৃত করে দিয়েছিল তার প্রকাশ পাওয়া যায় ৪৭ বছর বয়সে লেখা ‘শারদোৎসব’ নাটকে। মূলত ঋতু তথা প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে প্রথম কাজ এটিকে বলা যেতে পারে।
প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক আরও ভালোভাবে গড়ে ওঠে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর। ভৌগোলিকভাবে পূর্ব বাংলা থেকে বীরভূমের আবহাওয়া কিছুটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথের ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ রচনা থেকে জানা যায় প্রথম যুগের শান্তিনিকেতন ছিল নৈসর্গিক এক ছোট পল্লী, যেখানে প্রতিটি ঋতুই স্পষ্টভাবে জানান দিয়ে যায়। মনের উপর প্রভাব রেখে যাওয়া এই প্রকৃতিতে স্বভাবতই আশ্রমবাসের সময় প্রকৃতির সাথে কবির অন্তরের যোগ সাধনার পথটিকে সহজ করে দিয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে আমরা প্রায় পৌনে তিনশত প্রকৃতি পর্যায়ের গান ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের প্রচুর গান পাই।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা শ্রেয় যে কেতকী, ফাল্গুনী, বসন্ত, নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা, শেফালী, শ্রাবণগাঁথা, শেষ বর্ষণ গ্রন্থগুলো পুরোপুরিভাবেই প্রকৃতিকে আশ্রয় করে লিখেছেন।
বলা যায় তাঁর গানে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের সংযোগ ঘটেছে, পূর্ব বাংলা ও শান্তি নিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে। এই সংযোগে তাঁর জীবনের শেষ প্রান্ত জুড়ে এসেছে অবিচ্ছেদ্য পরিপূর্ণতা। সমসাময়িক গীতিকারদের গানে প্রকৃতিকে যেভাবে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের গানে সে প্রাপ্তি আরও বিশদভাবে হয়েছে।