গোপালগঞ্জে গুলিতে নিহত সোহেল মোল্লার স্বজনরা। ছবি: সংগৃহীত
‘তোমরা কি আমার বাবারে আইনে দিতে পারবা? কী দোষ করছিল আমার বাবা। আমার বাবাকে কেউ কোনোদিন খারাপ কইতে পারে নাই। ও তো কোনো দল করত না। ওর কেন এমন হবে’—বলে বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারান নিহত সোহেল মোল্লার মা লাইলী বেগম।
চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পর তিনি আবারও বলতে থাকেন, ‘ওরে বাবারে, আমার কবুতর নেই রে। ওরে তোমরা কেন মাইরা ফেলাইলা। তোমাগোও তো মা আছে, মা কইয়া ডাকো না, আমারে মা কওয়ার (বলার) আর কেউ নাই। আমাগো বাড়ি গোপালগঞ্জ হইতে পারে, আমরা তো কোনোদিন রাজনীতি করি না, বাবা। আমার একটা কবুতর, তার কেন এই হইল।’
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ই জুলাই) দুপুরে গোপালগঞ্জের মিয়াপাড়া এলাকায় নিহত সোহেল মোল্লার ভাড়াবাসায় গিয়ে দেখা যায় এই চিত্র। গত বুধবার (১৬ই জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘাতে নিহত চারজনের একজন সোহেল মোল্লা।
তিনি টুঙ্গিপাড়া পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাবাড়ির মো. ইদ্রিস আলী মোল্লার একমাত্র সন্তান এবং গোপালগঞ্জের চৌরঙ্গিতে কেরামত প্লাজায় মোবাইলের দোকান ছিল তার। মিয়াপাড়া এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় সোহেল মোল্লা মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন।
মিয়াপাড়ার ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার কক্ষে বসে রয়েছেন সোহেলের ষাটোর্ধ্ব বাবা ইদ্রিস আলী (ঠাণ্ডা) মোল্লা। বয়সের ভারে কথা বলতেই কষ্ট হয় তার। ছেলের শোকে বারবার বলছেন, ‘আমার ছেলে কী করেছে, কী অপরাধ ছিল তার, কেন তাকে গুলি করে মারা হলো। আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
এ সময় তার পাশে থাকা সোহেলের মামা জাহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘বুধবার বিকেলে মোবাইল ফোনে জানতে পারি, আমার ভাগনে সোহেল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। আমি আসতে আসতে হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়ি নিয়ে আসছে।’
তবে নিহত সোহেলের কোনো ময়নাতদন্ত বা ডেথ সার্টিফিকেট হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়নি। তার লাশ হাসপাতাল থেকে এনে রাতে গোপালগঞ্জের বাসায় নিচে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পূর্ব টুঙ্গিপাড়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নিহত সোহেলের স্ত্রী নিশি বলেন, ‘আমার সন্তানদের এতিম করা হলো কী অপরাধে? আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করত না। ব্যবসা আর বাসার বাইরে তার আর কোনো কিছুই ছিল না। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে যেত। আর কোনোদিনই সে তার মায়ের কাছে বলে বের হতে পারবে না’, এই বলে কাঁদতে থাকেন নিশি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, বুধবার বাসা থেকে বের হয়ে সোহেল দোকানে যান। দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি নিজের মোবাইল ফোনে সে সময়কার পরিস্থিতি ধারণ করতে গিয়ে নিহত হন। সোহেলের চার বছর ও আট মাস বয়সী দুটি ছেলেসন্তান রয়েছে।
গতকাল বিকেলে টুঙ্গিপাড়া পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সোহেল মোল্লার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার কবর পলিথিন দিয়ে ঢাকা রয়েছে। আর স্বজনরা বসে হাহাকার করছেন।
এ সময় কথা হয় সোহেল মোল্লার চাচা খলিলুর রহমান মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সোহেল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি ছেলে ছিল। রাজনীতি তো দূরের কথা, কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়াত না। এলাকার একটি মানুষও সোহেলকে খারাপ বলতে পারবে না। বুধবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে খবর পাই, আমাদের সোহেল আর আমাদের মাঝে নেই। বৃহস্পতিবার সকালে নিজ বাড়িতে সোহেলের লাশ দাফন করার পর তার বাবা-মা গোপালগঞ্জের সেই ভাড়াবাসায় চলে যায়।’
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন
