ছবি: সংগৃহীত
মশিউর রহমান শাওন
বাস্তব ও কল্পনার এক মিশ্র বিন্যাস ‘মায়াজাল’। ১০টি গল্প ও দু'টি অনুগল্পে রহস্য, মনস্তত্ত্ব, আবেগ ও সমাজ বাস্তবতার নিপুণ চিত্র এঁকেছেন লেখক সরোজ মেহেদী। জীবন, প্রেম, ক্ষতি ও নিঃসঙ্গতার ছোঁয়া পাওয়া যায় গল্পগুলোতে। সহজ ভাষার ব্যবহার প্রতিটি পৃষ্ঠায়। গল্পগুলোর গভীরতা উপলব্ধি করতে হলে পাঠককে হতে হবে মনোযোগী।
পাঠক হিসেবে বরাবরই বিশেষ কৌতূহল থাকে—লেখক কাকে উৎসর্গ করেছেন বইটি। ‘মায়াজাল’ এর উৎসর্গ পর্বের শুরুতেই রহস্যময় উক্তি ‘কাকে? জানি না।’ এটি যেন পাঠককে মায়ায় জড়িয়ে ফেলার প্রথম ধাপ। লেখকের ব্যক্তিগত শূন্যতা, না-পাওয়ার বেদনা কিংবা হারানোর ক্ষত—সবকিছুই এখানে এক অব্যক্ত অনুভূতির মতো এসে ধরা দেয়, যা পাঠকের মনকেও ছুঁয়ে যায়। যারা হৃদয়ের গভীরে ছোঁয়া দেওয়ার মতো গল্প পড়তে চান, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য।
আমার দৃষ্টিতে 'মায়াজাল’ শুধু বইয়ের নাম নয়, এটি প্রতিটি বাস্তব জীবনের অনুভূতির সূক্ষ্মজাল, যেখানে প্রবেশ করার পর আর সহজে বের হতে পারিনি। ‘বিবশ’ গল্পের নিশ্চুপ আব্বা চরিত্র, বিয়ের দিনে বড় আপার মৃত্যু কিংবা ‘নান্নু মিয়া ওরফে নুনু মিয়ার কল্পনার সানি লিওন ও মিয়া খলিফা।’ লেখকের গড়া চরিত্রগুলোর নিখুঁত বুনন—সবকিছুই আমাকে আবদ্ধ রেখেছে এক মায়াজালে। লেখকের এমন নির্মাণশৈলীর জন্য জানাই টুপি খোলা সালাম।
মায়াজালের ছালু ১০টি গল্প আর দু'টি অনুগল্পের মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অধ্যায় যেন। মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছালুর ছিল বাঁশি বাজানোর নেশা। গ্রামের মানুষের নেশা ছালুকে পাওয়া। পাড়া-মহল্লায় আসর জমিয়ে তোলা ছালুর মৃত্যু শেষ পর্যন্ত হলো চোর অপবাদ নিয়ে। লেখকের ওপর ভীষণ রাগ হয় আর ছালুর অসহায় বাণী, ‘আমি চুরি করি নাই, হাও কথা কইয়েন না’, নিয়েছে আমার পৌরুষের পরীক্ষা। কারণ, কথায় আছে, পরিস্থিতি যাই হোক, পুরুষের কাঁদতে নেই।
মায়াজালের ভেতর ‘মায়াজাল’। ‘শীত-পিঠা-পাখি-পৃথিবী আর রহমান সাহেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও শোষিত শ্রেণির একজন শ্রমিক হিসেবেই নিজেকে দেখেন তিনি। অবশ্য মনিবের গোলাম হওয়া তাকে হতাশ করে না। তবে আবছা অন্ধকারে শৈশবের মা আর স্বপ্নগুলো বুকে ভাঙনের ঢেউ তুলে। এই ভাঙন শুধু এক রহমান সাহেবের নয়। বাড়ি ছেড়ে আসার পর ‘মায়ের আদরের অভাবে পুষ্টিতে ভোগা’, আমার মতো প্রতিটি পাঠকের।
'অপ্সরী’তে প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের টান। ‘স্পর্শে’ মাটির প্রতি মায়া, গোমতীর পাড়, সুজাতলি গ্রাম আর মাশুকের লাল-হলুদ জুতা। নতুন ভোর সবার জন্য সুখের হয় না। সুখের হয়নি লেখক, লিটন আর নসিমনেরও।
‘চকোর মা’ শৈশব, চামেলি আপা, সাজিদ ও মিলির গল্প। সবার জীবনেই এমন এক মিলি প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন। ‘বুড়ি ও পরী’ গল্পে আজফর আলীর মিলি না থাকলেও ছিলেন ভাগ্নি কাকলী। আমার ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা নিয়ে খুব একটা ভয় কাজ করে না। তবে লেখক বৃদ্ধ আজফর সাহেবের জীবনের যে নানা রং দেখিয়েছেন, তাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি, বুড়ো হওয়ার আগেই নিজ সন্তানের বাইরেও সন্তান 'বানাতে' হবে।
মায়াজালের গল্পগুলো শুধু আবেগ আর বাস্তবতার জালে আটকে থাকেনি, বরং কখনো কখনো সাহসের পরীক্ষাও দিয়েছে। ‘উটপাখিকে’ অনেক সময় ভুল করে বলা হয়, ‘মাথা বালিতে গুঁজে রাখা’ প্রাণী, কিন্তু বাস্তবে এটি অত্যন্ত সাহসী ও আত্মরক্ষায় দক্ষ। মায়াজালের ‘উটপাখি’ ও ‘ফগার মেশিন’ গল্পও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ও অনাহারী মানুষের কথা যেমন লেখক তুলে ধরেছেন, তেমনি তথাকথিত মোটিভেশনাল গুরুরা কীভাবে বিভ্রান্তি ছড়ায়, তা-ও তুলে ধরেছেন।
এই ছোট দেশে এত চরিত্রের মানুষ! তা দেখে গল্পের চরিত্র ‘সামীর’ অঙ্ক মিলে না। অঙ্ক আমিও মেলাতে পারি না। অপরদিকে, মানুষ যে রাজনৈতিক জীব আর দেশপ্রেম রাজনীতির বিষয়, এই জটিল সূত্রকে সহজভাবে লেখক তুলে ধরেছেন ‘ফগার মেশিন’ গল্পে।
জীবনের টুকরো টুকরো কাহিনি, সমাজের কঠিন বাস্তবতা আর একরাশ আবেগ নিয়ে লেখক সরোজ মেহেদী যে গল্পগুলো উপহার দিয়েছেন, সেগুলো পাঠক মনে দীর্ঘদিন দাগ কেটে থাকবে।
আমার দৃষ্টিতে, মায়াজাল শুধু পড়ার জন্য নয়, অনুভবের জন্যও। মায়াজাল আপনার, আমার, সবার।
এইচ.এস/