অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের সাবেক সরকারের আমলে সারাদেশে নির্মিত ও নির্মিতব্য ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের টাকা আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দিয়েছিল বলে ধারণা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। তিনি মনে করেন, মসজিদগুলো নির্মাণের তহবিল মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে দেশে এলেও এর প্রেরক সিআইএ। তার মতে, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছেন, তারা অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। জিয়াউর রহমানের সময় ওঠা রুশ-ভারত বিরোধিতার আওয়াজে বামপন্থীদের একাংশ আকৃষ্ট হয়ে তার সঙ্গে সহযোগিতায় মেতে উঠে। এর ধারাবাহিকতা বর্তমানেও, অর্থাৎ ভারত ও রুশ বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে।
লেখক ও সমাজচিন্তক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা দুটিই দেশে টিকে আছে এবং সুযোগ পেয়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ আজও বিশ্ব পুঁজিবাদের অধীন। সে আত্মসমর্পণ করেছে বিদেশি শাসকের কাছে। শেখ মুজিবকে হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই দেশ শাসন করবে, তাদের মনের মতো করে তৈরি করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ঘটনাই পুনরায় ঘটছে বাংলাদেশে। এর সঙ্গে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আবশ্যকতাও দেশে ফিরে এসেছে। প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকার 'ইসলামিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের পরিচর্যা ও প্রসারের লক্ষ্যে' ২০১৭ সালে মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের কথা ছিল।
ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'বিগত সরকার দেশে যে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছিল, এর জন্য অর্থ ও অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এসেছিল, সে ব্যাপারে জনমনে বড় রকমের একটা জিজ্ঞাসা রয়ে গেছে। শোনা গিয়েছিল যে, টাকাটা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে; এমনও ধারণা ছিল যে ওই তহবিল মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু প্রেরক হচ্ছে সিআইএ।' দৈনিক আজকের পত্রিকায় লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি এসব কথা বলেন। 'নির্মম পৃষ্ঠপোষকতা' শিরোনামে তার এ লেখা গত ১৬ই জুলাইয়ের সংখ্যায় পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়।
তিনি লেখেন, 'এখন নাকি প্রকাশ পেয়েছে টাকা (মডেল মসজিদ নির্মাণের খরচ) অন্য কেউ দেয়নি, দিয়েছে সরকার নিজেই। একসময়ে ঢাকা শহরকে বলা হতো মসজিদের শহর। সেই সুখ্যাতি এখন বিলক্ষণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে; শুধু ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের কোথাও মসজিদের কোনো অভাব নেই। মসজিদ প্রতিষ্ঠার নামে সরকারি জায়গা দখল করা হয়েছে, এমন অভিযোগও বিস্তর শোনা গেছে। তার মধ্যে হঠাৎ করে আবার মডেল মসজিদ তৈরির আবশ্যকতা কেন দেখা দিল।'
তিনি মনে করেন, 'উপমহাদেশের যে সাংস্কৃতিক ভূমি ধর্মবাদিতা ও ধর্মভীরুতার বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী, সে ভূমি বাংলাদেশেও বিদ্যমান। বাংলাদেশে তার উর্বরাশক্তি বরং বেশি। কেননা, দেশটি অনেক বেশি দরিদ্র, অনেক বেশি পশ্চাৎপদ। দীর্ঘকাল এ ভূমি পরাধীন ছিল। আজও সে স্বাধীন নয়। আজও সে বিশ্ব পুঁজিবাদের অধীন। কাজেই মানুষ এখানে আত্মসমর্পণে অভ্যস্ত। সে আত্মসমর্পণ করেছে বিদেশি শাসকের কাছে, করেছে ভাগ্যের কাছে। তার আত্মবিশ্বাস নেই। তার জন্য খুবই প্রয়োজন পারলৌকিক আশ্রয়ের। যে জন্য ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা দুটোই টিকে আছে এবং সুযোগ পেয়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ দেশে।'
প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওই লেখায় বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছেন, তারা অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। পাকিস্তানের প্রতি দুর্বলতা ছাড়াও তাদের ভেতর আরেকটি প্রবণতা ছিল। সেটি হলো বাংলাদেশকে একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাদের প্রভু ও সমমনারা একদা যেমন করেছিল পাকিস্তানকে। তবে প্রয়োজনটা বাইরে থেকে আসেনি, উৎপন্ন হয়েছে ভেতরের প্রয়োজন থেকেই।'
তিনি বলেন, 'জিয়ার (সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) সময় রুশ-ভারত বিরোধিতার একটা আওয়াজ উঠেছিল। জিয়াই তুলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বামপন্থীদের একাংশ ওই আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে জিয়ার সঙ্গে সহযোগিতায় মেতে উঠেছিল। তাতে রুশ-ভারতের ক্ষতি-বৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন, জিয়াউর রহমানের বেশ সুবিধা হয়েছিল। তার শক্ত হাত আরও শক্ত হয়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই দেশ শাসন করবে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের পর থেকে, তারা রাষ্ট্রকে তাদের মনের মতো করে তৈরি করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ঘটনাই পুনরায় ঘটছে বাংলাদেশে। আর লেজ টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আবশ্যকতাটাও ফিরে এসেছে।'
খবরটি শেয়ার করুন