ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ই মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আট বছরের একটি মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। নির্যাতনের শিকার শিশুটি বর্তমানে ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, চার মাস আগে মাগুরা পৌর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে শিশুটির বড় বোনের বিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও ভাশুর থাকতেন। বিয়ের পর থেকে শিশুটির বড় বোনকে (পুত্রবধূ) অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন তার শ্বশুর। এরপর বোনের বাড়িতে বেড়াতে এলে মাত্র আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করেন বোনের শ্বশুর নামের নরপশু।
শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ‘পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’ (পিআইসিইউ) এনে ভর্তি করা হয় এবং দ্রুত অবনতি হতে শুরু করলে ওই রাতেই তাকে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়।
ঘটনা জানার পর সারাদেশের সভ্য ও বিবেকবান মানুষ ঘৃণা জানাচ্ছেন, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন। ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছেন। এর মধ্যে হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে বিচার কার্য শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় অভিযুক্ত চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।
শুধু মাগুরায় নয়, বিগত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ, বা গণধর্ষণ বেড়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছে। যদিও যত ঘটনা ঘটে, তার মাত্র দুই-একটি ছাড়া বাকিগুলো প্রকাশ-প্রচার হয় না। অসংখ্য নৃশংস ঘটনা আড়ালেই রয়ে যায়।
ধর্ষণকে সাধারণত ‘পুরুষের জৈবিক তাড়না’ হিসেবে দেখা হয়। এর অর্থ হলো, ধর্ষণ জৈবিক কাজ হলেও তা সামাজিক কারণে সংঘটিত হয়। সে কারণে এর জৈবিক নয়, সামাজিক প্রতিকারের প্রয়োজন। সামগ্রিক বিচারে ধর্ষণ গুরুতর অপরাধ।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পায় না বা প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। এখনও সমাজে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী-শিশুকে অপবাদ দেওয়া হয়, ধর্ষণকারী বুক ফুলিয়ে চলেন।
যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর মৃত্যু, বা বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ পায় না। অনেকে মামলা করেন না। সমাজের একশ্রেণির মানুষ ধর্ষণকারীর পক্ষে দাঁড়ায়, ‘ধর্ষিতা’ অপবাদ দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করে ভিকটিমকে।
ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর অধিকাংশেরই অবস্থান সামাজিকভাবে প্রান্তিক বা দুর্বল। মূলত ধর্ষণের শিকার হন খেটে খাওয়া পোশাককর্মী, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী নারী, দরিদ্র স্বল্পশিক্ষিত ছাত্রী, গৃহবধূ ও সংখ্যালঘু নারী।
পুলিশ স্টাফ কলেজের (২০১৮) গবেষণা অনুযায়ী, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের ৭০.৯ শতাংশের মাসিক কোনো আয় নেই এবং ১৯.৪ শতাংশ নারী ও শিশুর গড় মাসিক আয় মাত্র ২ হাজার ৮৪১ টাকা। যার কারণে এসব শিশু ও নারী মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমান সুযোগ পান না, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। অন্যদিকে বেশিরভাগ ধর্ষণকারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান-মর্যাদা ‘ভালো’।
দেশে ধর্ষণের হার বাড়ার প্রধান কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। প্রতি বছর যত ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা প্রক্রিয়ায় তদন্ত ও ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট ও আইনজীবীর অনাগ্রহ বা পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে চূড়ান্ত রায়ের আগেই মামলা ‘ডিসমিস’ হয়ে যায়।
আইনগতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানামুখী চাপের কারণে চার্জশিট দেওয়া হয় না। মামলার চার্জশিটের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুর্বলতার কারণেও ভুক্তভোগী শিশু ও নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি অশ্রদ্ধা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং অপরাধীদের দণ্ড থেকে অব্যাহতি- এসব কিছুর কারণে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে একশ্রেণির নরপশু জড়িয়ে পড়েন। অপরাধীরা জানেন, তারা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাবেন। তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এইচ.এস/