ছবি: সংগৃহীত
ফয়সাল আকবর
দৈনিক যুগান্তর থেকে অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি আমাকে খুব আহত করেছে। মামুন একজন পেশাদার সাংবাদিক। সে দৈনিক ইনকিলাব, সকালের খবর (এখন প্রকাশনায় নেই), সময়ের আলো, যুগান্তরে এক যুগ ধরে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করছে। একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে মামুনের বরখাস্ত হওয়া আমার কাছে খুব অপ্রত্যাশিত।
জুলাই বিপ্লবে যে কয়েক সাংবাদিক অফিশিয়াল দায়িত্বের বাইরেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রদান এবং ছাত্রদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, তার মধ্যে মামুন একজন। গত বছরের ১৬ই জুলাই সারাদেশে যখন আওয়ামী তাণ্ডব চলছিল, তখন মামুন খাগড়াছড়িতে ছিল। শুধু ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সে মোটর-বাইক, সিএনজি, অটো-রিকশা দিয়ে দশ হাজার টাকার বেশি খরচ করে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বসুন্ধরা এলাকার নিউজ কভার করার বাইরেও সে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেককে তথ্য দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেছে। জুলাই বিপ্লবে মামুনের ভূমিকা সম্পর্কে আকতার, নাহিদ, আকরাম, আলাউদ্দীন- সবার জানার কথা। সুতরাং, জুলাই বিপ্লবের পর একজন পেশাদার সাংবাদিকের চাকরি চলে যাওয়া আমাদের কাছে খুব অপ্রত্যাশিত।
সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মামুনের সর্বোচ্চ সহযোগিতা ছিল। এ বিষয়ে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ২০১৮ সালে নুরুল হক নুরদের (গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি) নেতৃত্বে যে কোটা আন্দোলন হয়েছে, সেটার শুরুর দিকে গণগ্রন্থাগার থেকে পাঁচ ছাত্রকে ঢাকার শাহবাগ থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে একজন আমার পরিচিত ছিল। তখন আমি আর মামুন নিজে গিয়ে শাহবাগ থানার তৎকালীন ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) আবুল হাসানের সঙ্গে কথা বলে সেই পাঁচজনকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি।
গত পনের বছরে ঢাকা শহরে বিএনপির নেতাকর্মীরা গুম-খুন কিংবা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলে মামুনই ক্রাইম রিপোর্টারদের মধ্যে একজন, যে তাদের রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। মামুনের এমন কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা বিএনপির নেতাকর্মী ও জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকসহ আমাদের সবার জানা উচিত।
এক. ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক ভাইকে যখন ২০২২ সালে কাউন্টার টেররিজম তুলে নিয়ে যায়, তখন মামুন নিজে আমার সঙ্গে ঢাকার মিরপুর থানায় যায়। আশিক ভাইয়ের বিষয় নিয়ে কয়েক দফা কথা বলায় উল্টো মিরপুর থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) তাকে ভর্ৎসনা করেন।
দুই. চট্টগ্রামের আলোচিত চেয়ারম্যান, জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক লেয়াকত আলী ভাইকে ২০২৪ সালে ঢাকা শহর থেকে ডিবি তুলে নিয়ে গেলে মামুনের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি। তারপর লেয়াকত চেয়ারম্যানের ভাগনে আরকানুল ইসলাম রুপক মামুনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে লেয়াকত ভাইয়ের বিষয়ে আপডেটেড থাকেন।
তিন. ২০১৬ সালে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরীকে দুইজন সহযোগীসহ ডিবি তুলে নিয়ে গেলে তার পরিবারের সদস্যরা এবং চট্টগ্রাম বিএনপির লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমি মামুনের সহযোগিতা নিয়ে ডিবি অফিসে যাই এবং আসলাম ভাই ও অন্যান্যদের খবর তাদের পরিবারকে জানাই।
চার. ২০১৫ সালের দিকে ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা ফেরদৌস মুন্না ভাইকে ডিবি ঢাকার পল্টন থেকে তুলে নিয়ে প্রথমে অস্বীকার করে। বিষয়টি ছাত্রদল নেতা আশিক ভাই ও আব্দুর রহিম আমাকে জানালে মামুনকে পল্টন থানা, মতিঝিল থানায় যেতে বলি। তারপর কোনো এক ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মুন্না ভাইকে আটকের কথা মামুনের কাছে স্বীকার করলে তাতে আমরা বড় আশঙ্কা থেকে নিশ্চিন্ত হই।
পাঁচ. ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষের জের ধরে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা থেকে আসা পাঁচজন ছাত্রদল কর্মীকে পল্টন থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তখনকার জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শহীদ ভাই বিষয়টি আমাকে জানালে সঙ্গে সঙ্গে মামুনকে নিয়ে পল্টন থানায় যাই। তারপর তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওসিকে (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) অনুরোধ জানাই।
বিএনপির দুঃসময়ে আমার স্মৃতিতে থাকা মামুনের কয়েকটি ভূমিকার কথা তুলে ধরেছি। সেই মামুনকে বিএনপির কোনো নেতার চাপে বরখাস্ত করা হয়েছে- এমন কথা আমার পক্ষে মানা কঠিন।
মামুনকে বরখাস্তের বিষয় জানার পর সাংবাদিক কমিউনিটির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জেনেছি, তা হচ্ছে, পুরান ঢাকার সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে অফিশিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে মামুন সরেজমিন ঘুরে একটি প্রতিবেদন তেরি করে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে, উক্ত ঘটনায় মামুন বিএনপির এক নেতার সম্পৃক্ততা পায়। সেই নেতার নামটি শিরোনাম করে নিউজটি জমা দিয়ে চলে আসে। যুগান্তরের প্রথম সংস্করণে সেভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
শিরোনামে সেই নেতার নাম থাকায় আরেক সাংবাদিকের অনুরোধে যুগান্তর কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সংস্করণে শিরোনাম পরিবর্তন করে। সেই পরিবর্তন করতে গিয়ে একটি শব্দ মিসিং হয়ে যায়। ফলে রিপোর্টটির শিরোনাম মিসলিডিং হয়ে যায়। 'বিএনপির নেতার চাঁদার বলি'র' পরিবর্তে 'বিএনপির চাঁদার বলি' হয়ে যায়। ফলে নিউজটির মাধ্যমে ভুল বার্তা তৈরি হয়। এর প্রেক্ষিতে যুগান্তর কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপে পড়ে। যার ফলে মামুনকে সাময়িক বরখাস্ত করে যুগান্তর কর্তৃপক্ষ। অথচ শিরোনাম বদল হওয়ার ক্ষেত্রে মামুনের দায় কম।
সর্বোপরি, মামুন একজন পেশাদার সাংবাদিক, স্বাধীনচেতা মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে মামুনকে আমি চিনি। সে ছাত্রমৈত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিল। মতের অমিল হওয়ায় ২০১৪ সালে ছাত্রমৈত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সাংবাদিকতায় যোগ দেয়। যুগান্তর সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার ভাই আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ।
আমি আশা করব, শিকদার ভাই মামুনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে প্রশস্ত রাখবেন। আর বিএনপির সংশ্লিষ্ট কেউ একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যুগান্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকলে তারা নিশ্চয়ই স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থাকবেন। যে রিপোর্টটি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, সেই একই রিপোর্ট সমকালসহ আরও পত্রিকা করেছে। শুধু শিরোনামের ভুলের জন্য কারো ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ পুরো দলের ইমেজ ক্ষুন্ন করবে।
লেখক: বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও সাংবাদিক।
খবরটি শেয়ার করুন