ছবি: সংগৃহীত
বাজারে খুবই অপরিচিত ‘মথ’ ডাল নিয়ে এখন অনেকের কৌতূহল। এই ডালে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে মুগ ডাল নামে বিক্রি হচ্ছিল। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে নমুনা পরীক্ষা করে তার প্রমাণও পেয়েছে। এরপরই ক্রেতাদের সচেতন করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সংস্থাটি। সংস্থাটির সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয় প্রতিটি সরকারি ওয়েবসাইটে। খবর প্রথম আলোর।
সরকারি সতর্কবার্তার আগে নাম না–জানা এই ডাল কোথায় থেকে আমদানি হয়, কীভাবে বাংলাদেশে এল, কারা আমদানি করে, কেনই–বা মুগ ডাল হিসেবে বিক্রি হয়, তা নিয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেল নানা তথ্য।
শুরুতে জেনে নেওয়া যাক, এই ডাল কোথায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যানে দেশে এই ডাল উৎপাদনের কোনো তথ্য নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মথ ডাল খরা সহনশীল ডাল–জাতীয় ফসল। এটি ভারতের স্থানীয় ডাল। বিশ্বে মথ ডালের সিংহভাগ উৎপাদন হয় ভারতে।
ভারতের বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে মথ ডাল উৎপাদন হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এটি পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। ভারতের মথ ডালের ৯৫ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয় রাজস্থানে মরু এলাকায়।
রাজস্থান সরকারের কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, রাজস্থানে গত ২০২৩–২৪ মৌসুমে ৪ লাখ ১৯ হাজার টন মথ ডাল উৎপাদিত হয়। রাজস্থানে এই ডাল বেশ জনপ্রিয়। এই ডাল দিয়ে পাঁপড় বানানো হয়।
বাংলাদেশে মথ ডাল আমদানি হচ্ছে শুধু ভারত থেকেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে মথ ডাল আমদানি শুরু হয়েছে। এর আগে গত পাঁচ বছরে এনবিআরের তথ্যে মথ ডাল আমদানির কোনো রেকর্ড নেই।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ২৩শে জানুয়ারি রাজশাহীর বিসমিল্লাহ ফ্লাওয়ার মিল হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে মথ ডালের প্রথম চালান আমদানি করে। প্রথম চালানে ৬২ টন মথ ডাল আমদানি হয়। ২০২৪ সালে সব মিলিয়ে ৮ হাজার ৫১৬ টন মথ ডাল আমদানি হয়।
তবে হঠাৎ এ বছর মথ ডালের আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। যেমন চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মথ ডাল আমদানি হয়েছে ২০ হাজার ৬৯১ টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০৮ শতাংশ বেশি।
বিসমিল্লাহ ফ্লাওয়ার মিলের হাত ধরে আমদানি শুরু হওয়া এ পণ্যটি এখন আমদানি করছে ৫৯টি প্রতিষ্ঠান। ভোমরা, হিলি ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে মূলত ভারত থেকে এই ডাল আমদানি হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, মুগ ডাল কিছুটা গোলাকার। আর মথ ডাল কিছুটা লম্বা আকৃতির। এরপরও হলুদ রং মেশানো মথ ডাল ও মুগ ডাল পাশাপাশি রাখা হলে তা শনাক্ত করা কঠিন। ব্যবসায়ীরা জানান, মুগ ডালের চেয়ে মথ ডালের আমদানির মূল্য কম। এ কারণে বেশি দামের জন্য মথ ডালকে মুগ ডাল হিসেবে খুচরায় বিক্রি হয়।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মুগ ডাল আমদানিতে কেজিপ্রতি দাম পড়েছে ১ ডলার ৯ সেন্ট বা ১৩৩ টাকা। অন্যদিকে মথ ডাল আমদানি হয়েছে কেজিপ্রতি ৮৫ সেন্ট বা ১০৪ টাকায়। অর্থাৎ মুগ ডালের চেয়ে মথ ডাল আমদানিতে কেজিতে ২৯ টাকা কম পড়ছে। খুচরা বাজারে মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
অন্যদিকে মুগ ডাল হিসেবে মথ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। দামের পার্থক্যের কারণে তাই মথ ডালই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে মথ ডালের আমদানিকারক নিউ মাতৃভান্ডারের কর্ণধার বাদল তালুকদার বলেন, ভারতের রাজস্থানে উৎপাদন হওয়া এই ডাল দিল্লিতে বড় কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপরই আমদানি হয়। আগের কিছু চালানে রং মেশানো থাকলেও এখন যেসব মথ ডাল আমদানি হচ্ছে, সেগুলোয় কোনো রং নেই। মুগ ডালের চেয়ে দাম কম থাকায় মথ ডালের চাহিদা বেশি বলে জানান তিনি।
পরিসংখ্যান ব্যুরো ও এনবিআরের হিসাবে দেখা যায়, দেশে বছরে গড়ে ৪৫ হাজার টন মুগ ডাল উৎপাদন হয় এবং বছরে গড়ে ৩০ হাজার টন মুগ ডাল আমদানি হয়। তবে মথ ডাল আমদানি শুরুর পর মুগ ডাল আমদানি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এ থেকে ধারণা পাওয়া যায়, বাজারে মুগ ডালের চাহিদা মেটাচ্ছে মূলত মথ ডাল।
যেমন ২০২২–২৩ অর্থবছরে ২১ হাজার টন মুগ ডাল আমদানি হয়। পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩–২৪–এ মুগ ডাল আমদানি কমতে শুরু করে। ওই বছরে মথ ডাল আমদানি শুরু হয়। তাতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মুগ ডাল আমদানি হয় প্রায় ১৮ হাজার টন। আর মথ ডাল আমদানি হয় ৯৯৬ টন।
গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মুগ ডাল আমদানি আরও কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৯১৩ টনে। এ সময়ে ২১ হাজার ৪১৪ টন মথ ডাল আমদানি হয়। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানির তালিকা থেকে কার্যত উধাও হয়ে গেছে মুগ ডাল। এ সময় পাঁচটি চালানে মুগ ডাল আমদানি হয়েছে ২১৩ টন। অন্যদিকে মথ ডাল আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৯ টন।
রং মিশিয়ে বাজারে ডাল বিক্রির অভিযোগে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে। গত ২৮শে অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, মুগ ডাল নামে বিক্রি হওয়া ৩৩টি নমুনার ১৮টিতে টারটাজিন নামের একধরনের হলুদ রঙের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরপরই অভিযান শুরু হয়।
এখন প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এ ধরনের অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। যেমন গত বুধবার (৫ই নভেম্বর) মথ ডালে রং মিশিয়ে মুগ ডাল বলে বিক্রির দায়ে টাঙ্গাইল শহরের ছয়আনী বাজারে দুই ব্যবসায়ীকে লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারমান জাকারিয়া বলেন, ডাল বা যেকোনো শস্যদানায় রং মেশানোর অনুমোদন নেই। টারটাজিন রং ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এ কারণে আমদানির সময় মুগ ও মথ ডালে রং পরীক্ষা নিশ্চিত করা এবং রং মেশানো ডাল যাতে আমদানি না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
খবরটি শেয়ার করুন