রবিবার, ১লা জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঝিঙেফুল

সাহিত্য ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৫:৫৩ অপরাহ্ন, ১৮ই মে ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

মাহবুব রহমান

মেয়েটাকে নতুন দেখছি। আগে কখনো দেখিনি আমাদের গ্রামে। আমাদের বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে একটা মাচার নিচে দাড়িঁয়ে। ঝিঙে মাচা। মাচা ভর্তি নরম শুভ্র ফুল। লম্বা বেণী কোমড় পর্যন্ত ঝুলছে। আমাকে দেখে সালাম জানালো। স্পষ্ট আর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। আর চোখগুলো সপ্রতিভ। 

টানা নয় দিন ঈদের ছুটি। প্রায় এক বছর পর গ্রামে ফিরছি। গ্রামগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। খড়ের চাল থেকে টিনের বাড়ি-টিনের বেড়া, এখন এসবের বদলে ধীরে ধীরে স্থান নিচ্ছে ইট কাঠ পাথরের দেয়াল। আম আর ঝিংনি গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে টানা হয়েছে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল। মোবাইল ফোনে ই-কমার্সে বাজার-সদাই করছে ব্যাপারির মেয়ে।  

কিন্তু তালমা নদীর দুই পাড়ের যে ভীষণ সৌন্দর্য তা ম্লান হয়নি এতটুকু। মেয়েটি বলে আপনিই তো সুবিনয়। গ্রামে আসার পর থেকে আপনার কথা অনেক শুনেছি। এখানকার মানুষ আপনাকে খুব ভালোবাসে। আমি মেয়েটির কথায় চমৎকৃত হই। বলি- আসলে এখানকার মানুষ এমনই। সহজ সরল আর সুন্দর। তাদের আছে ভালোবাসবার মতো, মানুষকে আপন করে নেওয়ার মতো এক প্রশস্ত হৃদয়।

দিঘির পাড়ে বাঁশের মাচায় বসে আমাদের অনেক কথা হয়। কথায় কথায় মেয়েটি জানায়, তার নাম বিপাশা। সে আরও জানায়, ৫ই অগাস্টের পর থেকেই তার বাবা ফেরারি। গা ঢাকা দিয়ে কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। তিনি যে রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান, আমাদের কে ডেকে বলেছেন, ‘আমার খুব বিপদ, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা নিজিদের মতো বাচোঁ। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে।’ মেয়েটি বলে, এরপর আমি আর মা, আপনাদের গ্রামে ওয়ালিদ মামাদের বাসায় চলে আসি।  

সূর্য ডুবে গেলে, গ্রামের বাড়িতে রাতের বেলা আমি জানালা খুলে দিই। প্রান্তর থেকে হু হু করে হাওয়া এসে ঘরে ঢুকে। নির্মল শীতল হাওয়া। আমার রুম ঘেঁষে ওয়ালিদ চাচাদের দেয়াল। এখন হাসনাহেনা ফোটার সময়। তাদের কল পাড়ে একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ আছে। তার সুতীব্র গন্ধে গোটা বাড়ি সুবাসিত। মৃদুমন্দ বাতাস। একটা অন্যরকম আমেজে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।   

রাত দশটার পর থেকে আরও নির্জন হয়ে ওঠে গ্রামটা। তখন বিপাশার রুম থেকে খুব করুন সুরে গান ভেসে আসে। সম্ভবত ল্যাপটপে সে লো ভলিউমে গান শুনছে। আমার রুম থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। আমি অবাক বিস্ময়ে শুনতে থাকি, সে কফিল আহমেদের মাসোনোবোফুকোওকা বাজাচ্ছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আবার কখনো মৌসুমি ভৌমিকের গান বাজচ্ছে। গভীর রাতে ভুপেন হাজারিকা গাইতে থাকে ‘মোর গায়েরো সীমানায় পাহাড়ের ওপাশে নিশিত রাত্রিতে প্রতিধ্বনি শুনি’।

রাতভর যেন আমার প্রিয় গানের তালিকা থেকে গান বাজিয়ে চলে বিপাশা। আর এসব ছাপিয়ে মেয়েটার মনে যেন একটা নিরব বেদনা সুরের সমান্তরালে বইতে থাকে। সে কি তার ফেরারি বাবার কথা ভেবে ভেবে ভেতরে ভেতরে অনেক ভেঙে পড়েছে। অথবা এ বয়সে বেদনার মতো এক ধরনের সৌন্দর্য বয়ে চলে মেয়েরা। দুঃখ ভরা চেহারায় তাদেরকে আরও সুন্দর লাগে।

পরদিন সকালে আমাদের দেখা হয়। দিঘির পাড়ে। আমরা বাশেঁর মাচার ওপর বসি। আমি তার সংগীত রুচির প্রশংসা করি। আমি বললাম, এ গানগুলো আমারও ভীষণ প্রিয় বিপাশা। দেখি, শ্যামল বরণ ডাগর চোখ মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়। বলে, আপনি গান ভালোবাসেন? এমন করে বলে, যেন সামান্য অনুরোধ করলেই সে গাইতে প্রস্তুত আছে। ভাবতে থাকি- নিশ্চয়ই চমৎকার গাইতে পারে, তাই এত আত্মবিশ্বাস। সুতরাং তাকে গাইতে অনুরোধ না করা এখন অভদ্রতার পর্যায়ে পরে।  

এক সময় আবিষ্কার করি সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী এই মেয়েটি নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কথায় কথায় তার বুদ্ধির ঝিলিক ভীষণ চমৎকৃত করে। ভালো লাগে তার সঙ্গ। এমন মেয়েকে জীবন সঙ্গী  হিসেবে পাওয়া যেন কোন ছেলের জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। নিজিকে সে সমর্পণ করতে প্রস্তুত। ভবিষ্যতের জন্য। সুন্দর একটি সংসারের জন্য। সুন্দর একটি বাড়ি, সুন্দর একটি উঠোন, আর সুন্দর একজন মানুষ। যে তাকে বুঝবে, গুরুত্ব দিবে, আগ্রহভরে কথা শুনবে। গল্প করতে করতে ভোর হয়ে যাবে রাত। তবু কথা ফুরুবে না। কিন্তু অনেক দেখেছি আমি। কেন জানি এমন চমৎকার মেয়েদের বরভাগ্য ভালো হয় না। ঠিক একটা খাপছাড়া সংসারে গিয়ে পড়ে। তারপর হাঁসফাঁস করে চলে জীবন ও সংসার। অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিপাশার জন্য তাই মায়া হয়। 

মাচায় সাদা সাদা নরম ঝিঙেফুল দোলে। দিঘির জলে আলোড়ন তোলে হাওয়া। একটা লাল ফড়িং জলের পৃষ্ঠ ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা করে। বিপাশা বলে, আমার বাবার যদি কিছু হয়, আমি কাউকে ছাড়বো না। প্রয়োজনে সন্ত্রাসী স্কোয়াডে নাম লেখাবো। আতঙ্কবাদী হব। বিপাশার গলায় ও কপালে নরম নদীর মতো রগ ফুলে ওঠে। কী যে অপরূপ লাগে। আমি কোন কথা খুঁজে পাই না। একটা পাথর ছুড়ে দেই পুকুরের জলে। একটা আলোড়ন তোলে একটার পর একটা ঢেউ গোল হয়ে ক্রমশ বিলীন হতে থাকে পাড়ের ধাক্কা লেগে। ধীরে ধীরে থেমে যায় ঢেউ। বিপাশা চলে যায়। আমি একা বসে থাকি। ঝিঙে মাচায় দোলে ঝিঙে ফুল। দুপুরের রোদ তীব্র হয়ে আসে ক্রমশ। তবুও বসে থাকি। একা, বিষন্ন মন নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে। কাল ফিরে যাবো ক্যাম্পাসে। 

কিন্তু গ্রামের এ মধ্য দুপুরের মতো বিষণ্ণ  সুন্দর জীবনে খুব একটা আসবে না ভেবে বড় বিহ্বল হয়ে যাই। সামান্য বিষয়গুলোও অপরূপ লাগে। যেন আর কিছু নয়, শুধু বেঁচে থাকাই এক মহান ব্যাপার।  

আরএইচ/

কবিতা গল্প ঝিঙে ফুল

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন