চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের আমন্ত্রণে চার দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে চীন সফর করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রথম চীন সফর। ভূ-রাজনৈতিক কারণে এবং অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সদ্যই ভারত সফর শেষ করে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। প্রভাবশালী এই দুই দেশের সাথে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ যে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে তা প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে আরও সুসংহত হবে এমনটাই আশা করা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি কারণে প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রথমত, ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা কারো অজানা নয় যে ভারত এবং চীন উভয়েই দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সদা তৎপর। দুটি দেশের সাথেই বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পরপরই চীন সফরে যাওয়ার মাধ্যমে দুটি দেশকেই সম্ভবত এই বার্তা দেয়া গেছে যে বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতির এই মূল মন্ত্র থেকে সরে আসবে না। ভারত এবং চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁদের নিজস্ব বিষয় এবং বাংলাদেশ তার নিজ স্বার্থে দুই দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখবে— প্রধানমন্ত্রী তা চীন সফরের পূর্বেই স্পষ্ট করে বলেছেন।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি করতে না পারায় বাংলাদেশ যখন একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে তৎপর হয় তখন চীন তাতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু ভারত সেখানে আপত্তি জানায়। ভারতের দ্যা টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক রিপোর্টে লিখেছে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে হওয়ায় ভারতের জন্য তা অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ এই করিডোর পশ্চিমবঙ্গের সাথে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সংযোগ স্থাপন করেছে এবং সেখানে চীনের উপস্থিতি তাঁদের জন্য অস্বস্তির।
ভারত তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগে আপত্তি জানালেও তিস্তা চুক্তি কার্যকরে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরেও এ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। তবে এ প্রকল্পে চীনের বদলে ভারত এখন বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনের বদলে ভারত কেন? এ নিয়ে অবশ্য সমালোচনা হচ্ছে। তবে একটি বিষয় এখানে লক্ষ করতে হবে যে তিস্তা নদী যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তাই ভারতকে পাশ কাটিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। চীনের সাথে আলোচনার কারণে ভারতও যদি এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। পাশাপাশি, দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে চীনের সাথে আলোচনা চালু রাখা যেতে পারে বা ভারত-চীনের যৌথ বিনিয়োগেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে পারে, যা কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় বলে প্রতীয়মান হবে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত এক দশকে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ হয়ে ওঠেছে। পদ্মা সেতু এবং বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন এবং প্রযুক্তির অবদান রয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সম্পর্ক আরও মজবুত হলে দেশের উন্নয়নের গতি বাড়বে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট' বা এইআইএর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীনের সাথে ২২টি সমঝোতা স্মারক সই এবং সাতটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফিজিবিলিটি স্টাডির সমাপ্তি ও দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি চুক্তির মতো বিষয়। চীনের এই নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর বাংলাদেশের বাণিজ্যিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, চীন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং চীন থেকে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়’। প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা সমূহ তুলে ধরেছেন এবং সরকার এ সংক্রান্ত যেসব কার্যক্রম নিয়েছে সেগুলোও তুলে ধরেছেন। তার আহ্বানের ফলে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা অত্যন্ত ইতিবাচক হবে।
চতুর্থত, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এই সংকট নিরসনে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে এমন একটি বার্তা চীনের কূটনীতিকদের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পূর্বেই দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরেও এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়। যদিও চীন এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি, প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়টি যেহেতু আলোচনার টেবিলে এসেছে তাই চীন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেবে বলে আশা করা যায়। শুধু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই নয়, ভবিষ্যতে তাঁদের ভরণ-পোষণের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তাতেও চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহায়তা চাইতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই চীনের সাথে সুসম্পর্কের উপর নির্ভর করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মাধ্যমে সেই সুসম্পর্কের পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেলো বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক দু’দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে চীন সফর করেছেন যখন দেশের অর্থনীতি বেশ কঠিন সময় পার করছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরে এই বিষয়গুলোই গুরুত্ব পেয়েছে। আগামী বছর চীন এবং বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে। বর্তমানে দুটি দেশের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অনন্য উচ্চতায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে পর চীনও অর্থনীতিকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত করতে চাইবে। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে এটাই প্রত্যাশিত।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
আই.কে.জে/