রবিউল হক
বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্যাপদ এদেশের মানুষের আত্মপরিচয়—সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাবসম্পদ। চর্যার ভাবসাধক কাহ্নুপা, বিরূপা পাহাড়পুড়ের সোমপুর বিহারের আচার্য ছিলেন। আর ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ভাবসাধকেরা ২০১৪ সালের মে মাস থেকে চর্যার উৎসভূমি পাহাড়পুড়ের সোমপুর বিহার থেকে শুরু করে সারাদেশব্যাপী চর্যাপদ পুনর্জাগরণের ঐতিহাসিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক পরিবেশনকলা হিসেবে চর্যাপদ এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। চর্যাপদের এই আলো শুধু মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সামাজে সীমাবদ্ধ না রেখে সকলের কাছে পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ভাব সাধকেরা তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। চর্যাপদ এদেশের মানুষের অমূল্য এক সম্পদ অথচ শিকড়কে ভুলে থাকার কারণেই এর পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা চলছে। তবে আনন্দের বিষয় যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভাব সাধকগণ বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ ড. সাইমন জাকারিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ভাবনগর সাধুসঙ্গের আদর্শ ও উদ্যোগে চর্যার পুনর্জজাগরণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
সাইমন জাকারিয়ার আধুনিক বাংলায় রূপান্তর করা চর্যাপদ সহজপাঠ্য হবার কারণে বাউল ফকির থেকে শুরু করে সকল সাধকের কাছে এটি আদি সাধনার ভাবসম্পদ হয়েছে খুব সহজেই। জাতীয় পর্যায়ে চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের এই কার্যক্রম এখন আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। আমরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটি, জাপানের হিরোশিমা ইউনিভার্সিটি, ইউনেস্কোর গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ভাবসাধকগণ চর্যাপদের গান পরিবেশনার পাশাপাশি চর্যাপদের গানের প্রশিক্ষণ প্রদান করে চলছেন।
২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে চর্যাপদ প্রকাশনার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আগত চর্যা পুনর্জাগরণের শিল্পীরা চর্যার সবগুলো পদ লোকসুরে পরিবেশন করেন। ২০১৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির বিপরীত পার্শ্বে রমনা কালী মন্দিরের ঠিক আগে উদ্যানের গোলাকার বেদিতে ভাবনগর ফাউন্ডেশন চর্যার পুনর্জাগরণের প্রথম সাধুসঙ্গ করেছিল। আর ২০২৪ সালে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের চর্যা পুনর্জাগরণের শিল্পীরা ৫০০তম আসর উদযাপন উপলক্ষ্যে তিন দিনব্যাপী চর্যাপদ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং চর্যার সবগুলো পদ পরিবেশনার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন।
এটি সুস্থধারার সাংস্কৃতিক চর্চার এক বিরল দৃষ্টান্ত। মোটকথা, চর্যাপদে বর্ণিত এর অন্তর্নিহিত ভাব সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক এই অভীষ্ট লক্ষ্যে ভাবনগর সাধুসঙ্গের ভাবসাধকদের প্রচেষ্টায় চর্যার পুনর্জাগরণ। আমাদের নিজেদের ভাবসম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সবার হয়ে উঠুক—এই প্রত্যাশা।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/