ছবি: সংগৃহীত
অভিনয়, সহজাত আবেগ ও পর্দায় রোমান্টিক অনুভূতির জন্য তিনি আজও ভক্তদের মনে অমর। চলচ্চিত্রে সমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখা, নতুন ধারা সৃষ্টি করা—সব মিলিয়ে সালমান শাহ ছিলেন এক যুগান্তকারী নায়ক, যার স্মৃতি এখনো দর্শক ও সহকর্মীদের অন্তরে জীবন্ত।
মাত্র চার বছরের অভিনয়জীবনে ঢালিউডে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন সালমান শাহ। ক্ষণজন্মা নায়ক হিসেবে কোটি দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫ বছর বয়সে তার ইহজাগতিক ভ্রমণের ইতি ঘটে। তার মৃত্যু ঘিরে রহস্য কাটেনি—আত্মহত্যা, নাকি হত্যা?
২৯ বছর আগে চিত্রনায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলাটি তদন্তের জন্য রমনা থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক গত সোমবার (২০শে অক্টোবর) এ আদেশ দেন। সুখবর ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ।
তিনি বলেন, সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করেনি পিবিআই। এ কারণে চার বছর আগে (২০২১ সাল) পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নারাজি দিয়েছিলেন নীলা চৌধুরী। আদালত সালমান শাহর মায়ের সেই রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করেছেন। একই সঙ্গে এ মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সালমান শাহ তখন থাকতেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার ফ্ল্যাটে। শুক্রবার সকালে বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে ইমনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ফিরে আসেন—দারোয়ান তাদের যেতে দেননি। নীলা চৌধুরীর চোখে সেই সকাল এখনো জ্বালা জমিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বাবাকে জোর করে ওপরে যেতে হয়েছিল।’
সালমানের মৃত্যুর পর বরাবরই সালমানের পরিবারের অভিযোগের তির ছিল তার স্ত্রী সামিরার দিকে। আর সামিরা বরাবরই এটি অস্বীকার করেছেন। গত বছর সাবেক স্বামী সালমান শাহর মৃত্যু প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন সামিরা। বেসরকারি টেলিভিশন টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামিরার দৃঢ় উচ্চারণ—‘আত্মহত্যা যারা করে, তারা তো কিছু বলে করে না...ইট ইজ সুইসাইড।’
নীলা চৌধুরীর অভিযোগের জবাবে সামিরা বলেন, ‘একটা বাসায় একটা বাচ্চা যখন আত্মহত্যা করে, তখন কি তার মা-বাবাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়? তাহলে আমাকে কেন?’
৬ই সেপ্টেম্বর সালমান শাহর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। আগের দিন তিনি ‘প্রেম পিয়াসী’ ছবির ডাবিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এফডিসিতে ছিল সেই ছবির ডাবিং। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন নায়িকা শাবনূর। খুনসুটি ও আনন্দময় মুহূর্তে যেন অদৃশ্য কিছু অশান্তি অপেক্ষা করছিল।
ডাবিংয়ের দিনে সালমান শাহ তার বাবাকে ফোন করে বলেন তার স্ত্রী সামিরাকে সাউন্ড কমপ্লেক্সে আনার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই বাবা সামিরাকে সঙ্গে নিয়ে এফডিসিতে পৌঁছান। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান, সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনসুটি করছেন। ওই সময়ের বেশ কিছু বিনোদন সাময়িকীতে শাবনূর ও সালমানকে নিয়ে একাধিক লেখালেখি হয়েছে, তাই শাবনূরের সঙ্গে সালমানকে খুনসুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা।
সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’—বিষয়টি বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার।
কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার। গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেলে সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তার সঙ্গে বাদল খন্দকারও নেমে পড়েন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দেন।
এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও সেদিন আর ডাবিং হয়নি। রাত ১১টায় সালমানকে নিউ ইস্কাটন রোডের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেন বাদল খন্দকার। রাতের ঘটনাগুলো নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছিল, তবে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে তা ধরা পড়েনি।
চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম জানান, শেষের দিকে সালমান মানসিক চাপে ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তাকে চাপের মধ্যে রেখেছিল। কিছুদিন নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সমিতিতে।
অভিনয়ের মাধ্যমে সালমান শাহ যেমন সবাইকে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন, তেমনি অমায়িক ব্যবহারের জন্য পেয়েছিলেন অনেকেরই প্রশংসা। চলচ্চিত্রে সালমানের জনপ্রিয়তা যখন আকাশচুম্বী, ঠিক তখনই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তাকে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই পুরো দেশ শোকে আচ্ছন্ন হয়। চলচ্চিত্রজগতের সহকর্মীরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না খবরটি।
সেদিন রাজধানীর রাস্তায় নামেন ভক্তরা। শোকমিছিল হয়। বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। মিডিয়ার খবরে শিরোনাম হয়, ‘বাংলা চলচ্চিত্র শূন্য হলো’। এমনকি সালমানের মৃত্যুর পরও এ দেশে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের কাছেও প্রিয় একটি নাম সালমান শাহ।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন