ছবি - সংগৃহীত
শংকর মৈত্র
সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আবার ফিরে আসলো সুপ্রিমকোর্টের কাছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ। গত ৮ বছরের বেশি সময় ধরে এটি ঝুলে ছিল। রিভিউ নিষ্পত্তির ফলে বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের পুরোনো বিধান বহাল রাখা হলো। এটা অনেকটা ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা সংসদে নিয়ে গিয়েছিল। উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে সেটা সংসদের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান করা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী রিট করলে হাইকোর্ট সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। পরে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় লিখেই আওয়ামী লীগ সরকারের রোষাণলে পড়েছিলেন। রায়ে বেশকিছু রাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা। যা পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দ হয়নি। ক্ষেপে যান এস কে সিনহার প্রতি। পতিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার সচিব, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দিয়ে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করে লজ্জাজনকভাবে দেশ থেকে বের করে দেন বিচারপতি এস কে সিনহাকে। দেশের প্রধান বিচারপতিকে এভাবে নির্যাতন করে দেশছাড়া করার নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কী না সন্দেহ। ফ্যাসিজমের চূড়ান্ত রূপ দেখা গিয়েছিল সেদিন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পতিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের চোখেমুখে।
বিচারপতি এস কে সিনহা দেশ থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলেন বটে তবে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হয় দুর্নীতিসহ নানাবিধ মামলা। একতরফা বিচারে সেই মামলার রায়ও দেয়া হয়। মোটকথা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে বিচারের নাম ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। সবচেয়ে মজার বিষয়, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে ঐকমত্যের রায় দিয়েছিলেন। পুরো রায়টি লিখেন বিচারপতি সিনহা। অন্যরা তা দেখে 'এগ্রি' করেছিলেন। এই রায়ের মাধ্যমে বিচারকরা তাদের নিজেদের বিচারের ক্ষমতা নিজেদের কাছেই রেখেছিলেন। সরকার হেরে গিয়েছিল।
কিন্তু সরকার বিচারকদের বিরুদ্ধে না গিয়ে অর্থাৎ তাদের না ক্ষেপিয়ে বিচারকদের মধ্যে ডিভাইড করে ফেলে। এস কে সিনহাকে একঘরে করে এবং অন্য বিচারকদের নানা প্রলোভন দিয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। বঙ্গভবনে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে অন্য ৬ বিচারপতি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সাথে দেখা করেন। রাষ্ট্রপতি বিচারকদের জানান এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে, তারা যেন নৈতিক স্খলনের কারণে তার সঙ্গে বিচারকার্যে না বসেন। বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা ঘোষণা দেন তারা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে আর বসবেন না। বেচারা এস কে সিনহা অসহায় অবস্থায় আর কী করবেন! সহকর্মীরাও সরকারের প্রলোভনে পড়ে তাঁর সঙ্গে বেঈমানী করলেন। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার ইচ্ছে ছিল এস কে সিনহা পদত্যাগ করলে তিনিই হবেন প্রধান বিচারপতি। হয়েছিলও তাই। দেশ থেকে লাঞ্ছিত করে বিচারপতি এস কে সিনহাকে বিদায় করার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হয় বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে। উনার প্রত্যাশা ছিল তাকে স্থায়ী প্রধান বিচারপতি করা হবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, লোভে যে পাপ হয় সে ঘটনা ঘটে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার ক্ষেত্রে। পতিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কূটবুদ্ধিতে আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে করা হয় প্রধান বিচারপতি। এ ঘটনার পর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা পদত্যাগ করে চলে যান।
অন্যদিকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার রিভিউ করে। কিন্তু এই রিভিউ আর শুনানি করেনি। নানা কূটচালে এটা শুনানি করতে দেননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ফলে প্রায় ৮ বছর ধরে বিচারপতি অপসারণের কোনো বিধান কার্যকর ছিল না দেশে। একদিকে সংবিধান সংশোধনী করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল, আরেক দিকে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সংশোধনী বাতিল। কোনটা কার্যকর কেউ সঠিকটা বলতে পারেন নি। আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ত্রাহি অবস্থা। হাইকোর্টের ৩ জন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠলে তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। কোন প্রক্রিয়ায় তদন্ত হবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফলে ৩ বিচারপতিকে শুধু বিচারকার্য থেকে বিরত রাখা হয় কয়েক বছর ধরে। তারা বসে বসে বেতন নেন, সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, শুধু বিচারকাজ করছেন না।
মোটকথা বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। আর এর মূল ক্রীড়নক ছিলেন আনিসুল হক। মানুষের দুর্ভোগ, মামলা জট কমানো নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তাভাবনাই ছিল না। কিভাবে আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কোন আদালতে তার চেম্বার সুযোগ-সুবিধা পাবে, এসব তদ্বির নিয়েই ছিলেন ব্যস্ত। নিম্ন আদালতের বিচারকরা বিশেষ করে ঢাকা কোর্টের বিচারকরা সন্ত্রস্ত থাকতেন আনিসুল হকের চেম্বারের তদ্বিরে। সব বড় বড় দুর্নীতি-অনিয়মের মামলা ছিল আনিসুল হকের চেম্বার, ব্যরিস্টার তাপসের চেম্বরের সিন্ডিকেট। বিচার বিভাগ এক ভয়াবহ দুঃসময়ে কাটিয়েছে।
এই অবস্থার অবসান হবে কী না জানি না। আরেক আনিসুল হক, আরেক তাপসের চেম্বার হয়তো সৃষ্টি হবে। যারা জিম্মি করে রাখবে বিচারঙ্গন। আর বিচারকরাও পানির মতো রূপ ধারণ করেন। শিরদাঁড়া উঁচিয়ে রাখতে পারেন না। স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের। বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্যও কমিশন করা হয়েছে। কিন্তু পদধ্বনি ভালো শোনা যাচ্ছে না। আদৌ সংস্কার কিছু হবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ লেগেই আছে।
তবে আপাতদৃষ্টিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর হওয়ায় কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে তা তদন্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু এটা যদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা হলেই বিপদ।
শংকর মৈত্র, সিনিয়র সাংবাদিক
আই.কে.জে/