সোমবার, ১লা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউরোপে ইমিগ্রেশন : সুযোগবঞ্চিত হবে কি বাংলাদেশ!

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৯:৫৯ অপরাহ্ন, ৩১শে জুলাই ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

পুরো ইউরোপের রাষ্ট্রনায়করা ইমিগ্রেশন ইস্যুতে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছেন। ইমিগ্রেশনবিরোধী দক্ষিণপন্থি দলগুলোর দ্রুত উত্থান, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ঢল, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিকের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আগমনের কারণে ইউরোপের সরকারগুলো একধরনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে, জার্মানি, ব্রিটেন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অব্যাহত কর্মীসংকটের খবর সরকারগুলোর জন্য ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থার তৈরি করেছে। 

ইউরোপের সরকারগুলোর মধ্যে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিকে সাধারণভাবে ইমিগ্রেশনবিদ্বেষী হিসেবে মনে করা হয়। সেই মেলোনিই এখন স্বীকার করছেন ইউরোপ ও ইতালির ইমিগ্র্যান্ট দরকার। তবে, সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধদের ইউরোপে প্রবেশের কঠোর অবস্থান বজায় রেখেই চলছেন। 

জার্মানিতে ইমিগ্র্যান্টবিরোধী গ্রুপগুলো শক্তিশালী হলেও তারা দীর্ঘদিনের কঠোর অবস্থান থেকে সরে কঠোর ইমিগ্রেশন নীতিকে সহজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেন অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য দোজখ বানাতে চেষ্টা করলেও বৈধ পন্থায় ব্রিটেনে প্রবেশের পথ অনেক ক্ষেত্রেই সহজ করেছে। 

ইতালীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে রোমে সম্প্রতি মাইগ্রেশন ইস্যুতে একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যেসব আলোচনা হয়েছে তার সারমর্ম হলো, শুধু চাপ দিয়ে লিবিয়া বা তিউনিসিয়ার মতো অবৈধদের প্রবেশদ্বারগুলো বন্ধ করা যাবে না। 

পারস্পরিক আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া এসব দেশকে মানবপাচার বন্ধে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত হলো অবৈধ মাইগ্রেশন বন্ধে মেডিটেরিয়ান এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা একীভূত করে কাজ করা ছাড়া কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না। 

এই সম্মেলনে ২০টি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশগ্রহণ করে। ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলনি কট্টর ইমিগ্রেশনবিরোধী পরিচিতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। পাশাপাশি ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চরম দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকদের দ্রুত উত্থান ঘটছে। 

এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চরমপন্থাকে ঠেকাতে সরকারগুলো হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যবসা সঠিকভাবে চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্য মানুষের অভাবে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত সমস্যার কথা তুলে ধরছে। 

ইমিগ্রেশন ইস্যুতে চরমপন্থার উত্থান সত্ত্বেও জার্মানি ইমিগ্রেশন ইস্যুতে উদার নীতির পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছে। সদ্য ঘোষিত নীতিকে আকর্ষণীয় করতে তারা সিটিজেনশিপ অ্যাক্টও পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে। দেশটির ঘোষিত নীতি অনেকাংশে কানাডার পয়েন্টভিত্তিক ইমিগ্রেশন পদ্ধতির অনুকরণে করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ঘোষিত নীতি অনুসারে দুই বছরের ডিপ্লোমা বা তদূর্ধ্ব শিক্ষা রয়েছে তাদের জন্য আরো কিছু শর্ত পালন সাপেক্ষে জার্মানির প্রবেশদ্বার খুলছে। আগের নিয়মে জার্মানির সমপর্যায়ের ডিগ্রির কথা বলা হলেও এখন আবেদনকারীর নিজ দেশের অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট থাকলেও হবে। 

এক্ষেত্রে সমপর্যায়ের প্রমাণ করার বিষয়টি রহিত করা হয়েছে। একইভাবে আগে জার্মান ভাষা জানা আবশ্যিক হলেও বর্তমানে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যায়ের ইংলিশ জানলেও আবেদনের যোগ্য হতে পারেন। 

ব্রিটেনে দুই বিপরীতমুখী চাপে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সরকার। একদিকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট ঠেকানো। অন্যদিকে, ব্যবসায়-বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় জনবলের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। নেট মাইগ্রেশন কমানোর জন্য সরকারের ওপর পাহাড়সম চাপ রয়েছে। 

আবার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে ধুঁকছে। ডাক্তার, নার্স, বয়স্ক ও অক্ষমদের দেখাশোনার জন্য কেয়ার ওয়ার্কার, বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে অভিজ্ঞ লোকবল এমনকি মাছ ধরার জন্য ফিশারম্যানও দরকার। সরকার এ খাতগুলোর জন্য ব্রিটেনে প্রবেশের শর্তও সহজ করেছে।

শত বিরোধিতা সত্ত্বেও মালটাসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও  বৈধ উপায়ে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এত পন্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এসব দেশে ইমিগ্রেশন ইস্যুতে নেতিবাচক একটি নাম? দুটি উদাহরণেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

ইতালিতে হাজার হাজার বাংলাদেশি বৈধ হওয়ার জন্য এমন কিছু আবেদন করেছে, যা বাংলাদেশ সরকারকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে কোনো শিশু অভিভাবকহীন থাকলে তাদের ব্যাপারে ইমিগ্রেশন নীতিমালা অনেক নমনীয় আচরণ করে।

অভিযোগ রয়েছে ইতালিতে অবৈধ পথে আসা হাজার হাজার প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি বৈধ হওয়ার জন্য নিজের পাসপোর্ট  ইচ্ছাকৃত হারিয়ে ফেলেছেন। তারা এখন বাংলাদেশ অ্যাম্বেসিতে সবাই বয়স কমিয়ে শিশু হিসেবে পাসপোর্ট চেয়েছেন। সরকার এ পাসপোর্টগুলো যদি ইস্যু করে তাহলে দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।

আবার ইস্যু না করলে হাজার হাজার বাংলাদেশির ইউরোপ থেকে বিদায় ঘণ্টা বাজবে। এ সর্বনাশা বুদ্ধিটা যারা দিয়েছেন তারা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। এসব দালালের কারণে ইতালিয়ান সরকারের চোখে বাংলাদেশ একটি নেতিবাচক নামে পরিণত হয়েছে। 

আরো পড়ুন: বিউটি পার্লারগুলো ছিল আফগান নারীদের দুঃখ ভোলার জায়গা

ব্রিটেনের জনবলের অভাব মেটানোর মতো যথেষ্ট লোকবল বাংলাদেশের আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবসম্মত না হওয়ায় এর সুযোগ নিতে পারছে না। ব্রিটেনে ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগ নিতে হলে পেশাভেদে ইংরেজির জানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 

সাধারণত নার্স ও কেয়ার ওয়ার্কারের জন্য আইইএলটিএস ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ দরকার হয়। এই পেশায় এই মুহূর্তের জনবল দরকার ৩০ হাজারের মতো। 

এই দুই পেশায় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। ভারত ও নাইজেরিয়া এই সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজিটা গুরুত্ব পায় না। তাই আমাদের এই সুযোগগুলোও কাজে আসছে না। 

একইভাবে, বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষার প্রসার ঘটলেও ডাক্তারদের ইংরেজির মান নিয়ে কেউই ভাবছেন না। ব্রিটেনের হাজার হাজার ডাক্তারের চাহিদা মেটাচ্ছে মূলত ভারত, মিশর, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো, যারা ইংরেজিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। 

শুধু ইংরেজির মান বৃদ্ধি এবং রোগীর সঙ্গে যথযথ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পারলে ইউরোপে উচ্চ বেতনে হাজার হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থান সম্ভব। হাইকমিশন বা অ্যাম্বেসিগুলোতে এ সংক্রান্ত তথ্য সহায়তা এবং বিদেশে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যথাযথ নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য অনেক রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সহজ হতে পারে।

এসি/ আইকেজে 


ইউরোপ ইমিগ্রেশন

খবরটি শেয়ার করুন