শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উদারতার মহিমায় উদ্ভাসিত এক শহর : এক লাখ মানুষের খাবার বিনামূল্যে

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৬:১৫ অপরাহ্ন, ১৮ই জুন ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টি চৌধুরী  রাফায়েল রাসেল :

শিখ ধর্মাবলম্বীদের হৃদয় বলে খ্যাত উত্তর ভারতের শহর অমৃতসর তার উদারতার জন্য সমধিক পরিচিত। এখানকার স্বর্ণ মন্দিরে দিনে এক লাখ মানুষের খাবার বিনামূল্যে পরিবেশিত হয়।

উত্তর ভারতের প্রায় বিশ লাখ লোকের শহর এই অমৃতসর। খাবার দাবার কিংবা ঐতিহাসিক স্থাপনা সবকিছুর জন্যেই বিখ্যাত এই শহর। তবে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত শিখ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাসনালয় স্বর্ণমন্দিরের জন্য। এই শহরের সবাই উদারতার মহিমায় এক সূত্রেই গাঁথা।

ষোড়শ শতকে এক শিখ গুরু এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। শহরটি পাঞ্জাবে অবস্থিত, যেখানে শিখ ধর্মের উদ্ভব হয়। এই শিখধর্ম তার সেবার ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। এই ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কোন ধরনের প্রত্যাশা না রেখে নি:স্বার্থভাবে মানুষের সেবা করা। সারা বিশ্বের শিখরা গুরুদ্বারে (শিখ মন্দির) সেবাকাজ করে। তারা প্রায়শই মেঝে পরিষ্কার করে, খাবার পরিবেশন করে এবং মন্দিরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো সাধারণ কাজ করে। অন্যরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে সেবামূলক কাজ করে। ২০২১ সালের এপ্রিলে কোভিড মহামারী ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে শিখ সম্প্রদায় অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ করে।

এই সেবামূলক কাজগুলো নি:স্বার্থভাবে করা হয় এবং শিখধর্মে সেবা শুধুমাত্র কোন ধর্মীয় নির্দেশ নয় বরং দৈনন্দিন অনুশীলন। 

সেবার অপর নাম প্রেম বলে অভিহিত করেন ২৩ বছর বয়সী অভিনন্দন চৌধুরী, যিনি ৮ বছর বয়স থেকে তার পরিবারের সাথে সেবামূলক কাজে জড়িত। 

ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও পুঁজিবাদী বিশ্বে এ ধরনের মন মানসিকতা সত্যিই অনুপ্রেরণার

শিখ ধর্মের উদারতার মহিমায় উদ্ভাসিত সারা বিশ্ব। কোভিড লকডাউন চলাকালীন, ইংল্যান্ডের একটি গুরুদ্বারে শিখ স্বেচ্ছাসেবকরা এনএইচএস কর্মীদের মাঝে দিনে হাজার হাজার খাবার সরবরাহ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে শিখরা বিনামূল্যে কয়েক হাজার মানুষের খাবার রান্না করেন। ঝড়ে বিধ্বস্ত কানাডা কিংবা সাইক্লোন আক্রান্ত নিউজিল্যান্ড, সব জায়গাতেই শিখরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু অমৃতসরে শিখ ধর্মের এই মানবিক আচরণ অন্য মাত্রাতেই প্রবাহিত। এই শহরে কেউ কখনও অভুক্ত থাকেনা। স্বর্ণমন্দিরে যে কারো জন্য সবসময় গরম গরম খাবার প্রস্তুত থাকে।

এই স্বর্ণমন্দিরের রান্নাঘর বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম রান্নাঘর। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিদিন এক লাখ মানুষের জন্য খাবার রান্না করা হয়। 

নিউইয়র্ক ভিত্তিক মিশেলিন স্টার শেফ বিকাশ খান্নার জন্ম এই অমৃতসরে। তিনি কোভিড লকডাউনের সময় ভারতে লক্ষাধিক খাবার বিতরণ করেছিলেন। মূলত অমৃতসরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শেফ এখানকারই সেবামূলক কার্যক্রম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

সমস্ত গুরুদ্বারের মতো, এই স্বর্ণমন্দিরটিও স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত। তারা এখানে আগত প্রত্যেককে খাবার পরিবেশন করেন। বিরাট হলঘরে একসাথে ২০০ জন লোক খাবার খেতে পারেন। প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর এই হলঘর পরবর্তী লোকেদের খাওয়ানোর জন্য পরিষ্কার করা হয়। 


আরো পড়ুন: হুনিশে : ভারতের নাগাল্যান্ডের প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম


শুধু অমৃতসরের মন্দিরেই নয় এ শহরের আনাচে কানাচে যেন উদারতার মনোভাব পরিপূর্ণ। রাতে একা হাঁটতেও এখানে ভয় নেই। বাইরের হোটেলে খাবার খেতে বসলেও এখানকার লোকেদের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পাওয়া যায়। 

অমৃতসরে বেড়ে ওঠা রাহাত শর্মা জানান, এ শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুইটি ধর্ম শিখ এবং হিন্দু। তারা একে অপরের সাথে মিলেমিশেই এখানে বাস করেন।

তবে এই অমৃতসর শহরের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ইতিহাস। পাঞ্জাবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, এই অমৃতসর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ছিল সমাবেশ এবং বিক্ষোভের কেন্দ্রে। তবে ১৯১৯ সালে এ শহরে ঘটে যায় এক নৃশংস ঘটনা। ব্রিটিশ জেনারেলের আদেশে জনগণের শান্তিপূর্ণ সভায় গুলি চালানো হয়, যা ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা নামে পরিচিত। এ ঘটনায় প্রায় ১৫০০ নিরীহ লোক মারা যান।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ত্যাগ করে তখন ভারত বিভাগের প্রভাব অমৃতসরে খুব বাজেভাবে পড়ে। এসময়ের সহিংসতার স্মৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে এখানে ভারতের প্রথম এবং একমাত্র পার্টিশন মিউজিয়াম খোলা হয়।

১৯৮৪ সালে, অমৃতসরে আবার এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সামরিক বাহিনিকে নির্দেশ দিলে তারা স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালায়। এর কয়েক মাস পর দুইজন দেহরক্ষীর দ্বারা নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। পরবর্তীতে সারা ভারত জুড়ে হাজার হাজার নিরীহ শিখদের হত্যা করা হয়।

শিখদের জন্য এই ঘটনাগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। শিখ শহীদদের গল্প তাদের সংস্কৃতির অংশ। প্রায়ই প্রার্থনার সময়েও এ ঘটনাগুলো বলা হয়। তবে ঘটনাগুলো শিখদের প্রতিশোধপরায়ণ না করে উদারতার শিক্ষা দেয়।

তাই এ ধর্মাবলম্বীদের উপর এত অত্যাচারের পরেও তারা আজও উদারতায় বিশ্বাসী। অমৃতসরের প্রতি আনাচে কানাচে দয়া, উদারতা ও ভালোবাসার মনোভাব সর্বদা বিরাজিত।

সূত্র: বিবিসি

এসি/ আই.কে.জে/

উদারতা মানুষ খাবার

খবরটি শেয়ার করুন