শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একাত্তরে পাকিস্তানের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জোরালো দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০২:০০ অপরাহ্ন, ২রা জুলাই ২০২৩

#

উজায় বুলুত

পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি অবিলম্বে প্রয়োজন। ২৯ মে, অন্যান্য বাংলাদেশি প্রবাসী সংস্থার সাথে একত্রিত হয়ে বাসুগ (বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ) জাতিসংঘের মহাসচিবকে চিঠি লিখে জানায়, বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যায় প্রায় ৩০ লাখ লোক নিহত হয়েছিলেন এবং ২ লাখেরও বেশি নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। এছাড়াও ১ কোটিরও বেশি মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে শুধু জীবন বাঁচাতে সীমানা পেরিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

নিরাপত্তার সন্ধানে ২ কোটিরও বেশি নাগরিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সারাবিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভে পাওয়া খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং প্রকাশনাগুলো এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে।

আর্মেনিয়ান, অ্যাসিরিয়ান এবং গ্রীকদের তুর্কি গণহত্যা (১৯১৩-১৯২৩) এবং ইহুদিদের জার্মান গণহত্যার (১৯৩৮-১৯৪৫) পরে সংঘটিত হলেও, এটি কম মারাত্মক ছিল না।

জাতিসংঘের কাছে প্রেরিত চিঠিতে জানানো হয় যে, বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিকল্পিত ছিল। বিহারি ও বাঙ্গালি সহযোগিদের সহায়তায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি দ্বারা এ গণহত্যা পরিকল্পিত ও সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যার মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর মাধ্যমে। ওই রাতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার নিরীহ বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

সেদিন থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযান শুরু করে, যা ১০ মাস ধরে চলে। ১০ মাস ধরে চলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৩ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দুটিই শেষ হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।

চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করা হয়।

বাংলাদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিবরণ দিয়ে জানান কোন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষেরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজেদের পৃথক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের নিজস্ব ভাষা চর্চার অধিকার প্রদান করেনি। তাছাড়া তাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য এবং শিল্পচর্চারও কোনও অধিকার ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি বলে অভিহিত করে বারবার আক্রমণ চালিয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে, আরবি ও উর্দু শব্দ দিয়ে বাংলা শব্দের পরিবর্তে বাঙালিদের বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়। তারপর, ১৯৬০-এর দশকে, রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া যেমন টেলিভিশন এবং রেডিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান নিষিদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর লেখা গান ও কবিতা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল। হিন্দুয়ানি হিসেবে অভিহিত করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আক্রমণের ফলে বাঙালিরা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের উপর জোর প্রদান করে। 

বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অর্থনৈতিক বৈষম্যের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়। সে সময়কার প্রধান রপ্তানি আয়ের পণ্য পাট, পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত হলেও, সিংহভাগ বিনিয়োগ চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈমাত্রেয় আচরণ বুঝতে শুরু করে।

হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন উল্লেখ করে যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দমন, অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিতকরণ এবং বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী কারণের চূড়ান্ত পরিণতি।

পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক অভিজাতরা ইসলাম এবং উর্দু ভাষা দ্বারা সমন্বিত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায়, তারা বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষাকে দমন করার চেষ্টা চালায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং ভারতের সরকারি চিঠিপত্র এবং নথি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ১৯৭১ সালের গণহত্যার মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুরা। তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির উপরেই পাকিস্তানি বাহিনি হামলা চালায়। 

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে, ১৫ লাখ বাঙালি বাস্তুচ্যুত হয়। নভেম্বর নাগাদ এক কোটি বাঙালি, যাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু, ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 

হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে, কিমটি কুন্ডু সম্প্রতি এই গণহত্যার অপরাধীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এ গণহত্যা শুরু করে। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং সৈন্যদের আটক করা। 

মূলত পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিরাট পার্থক্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান মূলত ইসলামিক এবং উর্দুভাষী অঞ্চল ছিল। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি হিসেবে অভিহিত করে তাদের নিকৃষ্ট হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের গণহত্যার মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুরা। 

১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি এবং তাদের সহযোগীদের লক্ষ্য ছিল সমস্ত পুরুষদের হত্যা করে হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্মূল করা।

পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের নিকৃষ্ট হিসেবে প্রমাণিত করে নিজেদের সবসময় শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করতো পশ্চিম পাকিস্তানিরা।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ৮০ লাখ শরণার্থীদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই ছিল হিন্দু। পশ্চিম পাকিস্তানিরা উপলব্ধি করতে পারেনি এ বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতকেও যুদ্ধে শামিল করতে বাধ্য করবে। মূলত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার চেয়ে ভারতের কাছে সশস্ত্র সংঘাতই ছিল সহজ সমাধান। 

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ২০% ছিল হিন্দু। ধারণা করা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যার শিকার হওয়া ৫০% মানুষই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। গণহত্যা বিষয়ক আমেরিকান নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত রুডলফ জোসেফ রুমেল বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানি এবং তাদের মৌলবাদী মুসলিম সহযোগীদের দৃষ্টিতে হিন্দুরা ছিল নাৎসিদের কাছে ইহুদিদের মতো। বেশিরভাগ হিন্দু নারীরা ধর্ষণের শিকার হয় এবং তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ জেনোসাইড স্কলারস (আইএজিএস) দ্বারা সাম্প্রতিক একটি বিবৃতি জারি করে গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বিশ্ব সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

তারা নিশ্চিত যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার উপর উপলব্ধ ডকুমেন্ট জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঠিক কী ঘটেছিল তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। তাছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদান। যাতে আর কেউ এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে পারে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনও গণহত্যা না ঘটতে পারে সেজন্য অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। 

এসব দিক বিবেচনা করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অথচ উপেক্ষিত অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি। 

সূত্র: গেস্টোন ইন্সটিটিউট



Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন