ছবি: সংগৃহীত
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট আনু মুহাম্মদ মনে করছেন, দেশে উগ্র ধর্মবাদী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতায় শুধু ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুরাই নন, নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাসী ও ধারার মুসলমানরাও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছেন। শিল্পকর্মসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিহ্ন আক্রান্ত হচ্ছে। মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা, সহিংসতা বা চাপ সৃষ্টি করা, হামলা-হুমকির দেশে যে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের নামে হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'রাজনৈতিক পরিবারের লড়াই, অর্জন এবং নিপীড়নের অভিজ্ঞতার অংশীদার' বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাবেক পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, বাংলাদেশ আমলে এইচ এম এরশাদ ও শেখ হাসিনা- এই তিনজনের শাসন এবং পতনের আন্দোলনে যে মিল পাওয়া যাচ্ছে, এরও ব্যাখ্যা দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তার দাবি, ওই তিন সরকারের আমলেই উন্নয়ন মডেলের প্রধান কারিগর ছিল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি গোষ্ঠী। তিন আমলেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং সামরিক-বেসামরিক আমলা ও নানা বাহিনীর হাতে।
তিনি বলেন, 'উগ্র ধর্মবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতায় শুধু ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষরাই নন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সুফি, আহমদিয়া, বাউল ধারার মানুষরাও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছেন। শিল্পকর্মসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিহ্ন আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরজবরদস্তি ও দখলদারত্ব চলতে থাকায় তা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া দাঁড়াতে দিচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'গণ–অভ্যুত্থানে সব ধর্ম-মত, লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছেন। অপ্রতিরোধ্য শক্তি, সংহতি ও গণতান্ত্রিক চৈতন্য খুবই শক্তিশালী পর্যায়ে গেছে এই সময়। কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর অসহিষ্ণু বা নিপীড়ক একেকটা পক্ষ আবির্ভূত হচ্ছে। মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা, সহিংসতা বা চাপ সৃষ্টি করা, হামলা-হুমকির একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সেটা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের নামে হচ্ছে।'
গত ২১শে জুলাই দৈনিক প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত এক কলামে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। 'গণ–অভ্যুত্থানের মালিকানা কাদের হাতে চলে যায়' শিরোনামে তার ওই লেখা প্রকাশিত হয়। আনু মুহাম্মদ দীর্ঘ সময় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির অন্যতম সংগঠক। তিনি ত্রৈমাসিক ‘সর্বজন কথা’ পত্রিকার সম্পাদক।
প্রসঙ্গত, মৌলভীবাজার ও সিলেট অঞ্চলে বসবাস করেন কিছু মানুষ, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান হলেও জাতিসত্তার বিচারে মণিপুরি। মুসলমান হলেও রীতিনীতিতে তারা মূলধারার বাঙালিদের চেয়ে ভিন্ন। সাংস্কৃতিকভাবে মণিপুরিদের সঙ্গে তাদের মিল বেশি। ধর্মচর্চা থেকে শুরু করে বিয়ে- সবই ইসলাম ধর্মমতে তারা পালন করেন। তবে নানা সামাজিক অনুষ্ঠান তারা উদযাপন করেন নিজেদের মতো করে। মসজিদে জুমার খুতবা বা বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনাও তারা করেন পাঙাল ভাষায় এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে তারা বিয়েশাদীও করেন নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে। তাদের বলা হয়ে থাকে, দেশের 'সংখ্যালঘু মুসলমান'।
ধর্মীয় উগ্রবাদের তৎপরতা কোনো সমাজে বাড়লে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ নির্দিষ্ট ভাবধারায় বিশ্বাসীরা আতঙ্কে থাকেন। তারা হয়ে ওঠেন 'এক ধরনের সংখ্যালঘু'। গত বছরের ৫ই আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটে। মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে ঘিরে মানুষ আহত হন, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙবার আহ্বান জানানো হয়। ফলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সুফি, আহমদিয়া, বাউল ধারার মানুষরাও এখন 'এক ধরনের সংখ্যালঘু' হয়ে উঠছেন বলে অনেকের অভিমত।
আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোর কলামে লেখেন, '১৯৬৯, ১৯৯০ ও ২০২৪—এই তিন গণ–অভ্যুত্থানেই তিন স্বৈরশাসকের, আইয়ুব-এরশাদ-হাসিনার পতন হয়। তিন শাসনকালেই স্বৈরশাসনের প্রধান যুক্তি ছিল উন্নয়ন, তিন শাসকের মধ্যে প্রথম দুজন ছিলেন জেনারেল, তৃতীয়জন রাজনৈতিক পরিবারের লড়াই, অর্জন এবং নিপীড়নের অভিজ্ঞতার অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও নিজেই কুশাসন, দুর্নীতি ও নিপীড়নে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।'
তার মতে, 'আইয়ুবের পতন হয় তার প্রচারিত উন্নয়ন দশক উদ্যাপনের পর, এরশাদের পতন হয় একই রকম দশকের শেষে এবং হাসিনার পতন হয় অনির্বাচিতকালে কথিত উন্নয়ন দশকের মহাসড়কে অবস্থানকালে। তিন আমলেই জিডিপি বেড়েছে, শানশওকতও দেখা গেছে কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে বিবিধ বৈষম্য। দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ও বৈষম্য বৃদ্ধি সামগ্রিক নীতিকাঠামোর মধ্য দিয়েই ঘটেছে। স্বৈরশাসন তারই রাজনৈতিক রূপ।'
তিনি বলেন, 'মনে রাখতে হবে যে, তিন আমলেই এই উন্নয়ন মডেলের প্রধান কারিগর ছিল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি গোষ্ঠী। তিন আমলেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং সামরিক-বেসামরিক আমলা ও নানা বাহিনীর হাতে। একদিকে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, অন্যদিকে মানুষের ওপর নজরদারি, জুলুম অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল। শেষ দশকে নজরদারি, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায় অনেক বেশি।'
তিনি লেখেন, '১৯৬৯–এ গণ–অভ্যুত্থান প্রবল রূপ নেয় আসাদুজ্জামান নামের একজন রাজনৈতিক সংগঠক মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার পর। ১৯৮৭ সালে নূর হোসেন, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের নিহত হওয়ার ঘটনাও একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, ২০২৪ সালেও রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পরই আন্দোলন তীব্র হয়। এরপরও সরকার যখন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখে, তখনই ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।'
খবরটি শেয়ার করুন