বুধবার, ২৩শে জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** সচিবালয়ে ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ১২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা *** জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিলেন বিশ্ব আদালত *** প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিমানবাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ *** এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা একই দিনে হচ্ছে না, নতুন রুটিন প্রকাশ *** বাগমারা বিদ্যালয়ের নাম বদল, নতুন নাম শহীদ জিয়া বিদ্যালয় *** মতপার্থক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য আরও দৃশ্যমান করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার *** রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কর্ণফুলী টানেলে ৪ দিন যান চলাচল সীমিত থাকবে *** শুল্কে সুবিধা পেতে আমেরিকার গম বাড়তি দামে কিনবে সরকার *** টুঙ্গিপাড়ায় ২৮২ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা *** ভোটের দিন গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালা জারি ইসির

দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন চরাঞ্চলের মানুষ

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, ১০ই জানুয়ারী ২০২৫

#

ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

বাংলাদেশে নদী অববাহিকায় জেগে ওঠা চর কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে করে  চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবনমান ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের প্রায় সব চরাঞ্চলেই সবজি ও ফসলের উৎপাদন  এবার বেশ ভালো। কিছু ফসলের বাম্পার ফলন এবং প্রচলিত ফসলের বাইরে নতুন ধরনের সবজি চাষে ব্যাপক সাফল্যে নতুন আশায় দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন চরাঞ্চলের মানুষ। 

স্থানীয়রা জানান, চরে  বর্তমানে অভাবি মানুষ নেই। চাষাবাদ করে চরের বাসিন্দারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। চরবাসীর এই উন্নয়নে কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলেও তারা মনে করেন। এছাড়াও বর্তমান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চর নিয়ে দখলবাজদের ক্ষমতার লড়াইও এখন আগের মতো নেই। একসময়ের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে চরাঞ্চলে এখন কেবলই আশার আলো। 

একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চরাঞ্চলের উৎপাদিত সবজি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পরীক্ষামূলক আবাদকৃত কয়েকটি সবজির ফলনে আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় দেশের চরাঞ্চল নিয়ে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দেশের সকল চরাঞ্চলের উপযোগী ফসল চাষাবাদে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।’ 

চরাঞ্চলের কৃষকদের মতে, চরাঞ্চলের জমি অসমতল ও বালির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ইরি-বোরোর পরিবর্তে ছয়-সাত ধরনের ফসল চাষ করা যায়। চরের জমিতে আখ চাষের পর লাল শাক, পাট, কলমি শাক চাষ করা যায়। এসব সবজি রোপণের ১৫ দিন পর বাদাম, মরিচ, ঢেঁড়স ও পুঁইশাকের বীজ বপন করা যায়। এক মাসের মধ্যে সবজি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হয়। সবমিলিয়ে চরাঞ্চলে বিশেষত সবজি উৎপাদনে বিরাট সুযোগ রয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীত মৌসুমে রংপুরসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে ৩৫ থেকে ৫০ ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রংপুর অঞ্চলের ৮ জেলায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ টন সবজি। এতে করে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আয় করবে এখানকার কৃষকরা। 

চর সাধারণত দুই ধরনের।  দ্বীপচর এবং সংযোগ। দ্বীপচর হলো- নদীর মধ্যে শুধু বালুরাশির দ্বীপ, যার চারপাশে সারা বছর পানি থাকে। আর সংযোগ চর হলো- সাধারণ প্রবাহে নদী তীরের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডে থাকে। ১ হাজার ৭২২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত নদীর হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল গতিশীলতার উপজাত হিসেবে অথবা নদী তীরের ভূমি ক্ষয় ও ভূমি তৈরির ফলে চর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলের ৩১টি জেলার মোট ১১০টি উপজেলায় ১৬ শতাংশের ওপর এবং ১০৬টি উপজেলায় ৮-১৫ শতাংশে আংশিক চরাঞ্চল বিরাজমান। 

অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১৬ শতাংশ চরভূমি। এসব চরভূমিতে প্রায় কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ শত শত নদী অববাহিকার দেশ। জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক নিয়মে এসব নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠে। কারণ বাংলাদেশের নদীগুলো উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর অবধি প্রতিবছর কোটি কোটি টন বালি ও কাদা বয়ে নিয়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত এসব বালি-কাদায় উঁচু হয়ে ওঠে নদ-নদীর তলদেশ। আর তাদের সঙ্গমস্থল বা মোহনার মুখে জেগে ওঠে নানা আকৃতির চর। 

গত কয়েক দশকে নদীভাঙন ও অন্যান্য কারণে সর্বস্ব হারানো মানুষেরা অবস্থান নিয়েছেন চরাঞ্চলে। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই নির্জন ধু-ধু বালুচরে দলে দলে গড়ে তুলেছেন মাথাগোঁজার ঠাঁই। সেখানে অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যদিয়ে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। নেই রাস্তাঘাট, নেই সুপেয় পানি ও সেচের পর্যাপ্ত সুবিধা। পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে বসবাসের সুযোগ পেলেও সেখানে তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ সংগ্রামের। 

তবে বর্তমানে দেশের চরগুলোতে কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।  ক্ষুদ্র ঋণ, কৃষিঋণ, বীজ ও সার সহায়তা পাচ্ছেন চরের কৃষকরা। এভাবেই গত প্রায় দুই দশকে সেসব চরাঞ্চলবাসীরা নিজেদের প্রয়োজনে চরের দৃশ্যপট এখন অনেকটাই পাল্টে দিয়েছেন। অথচ একদশক আগেও চরের মানুষ বলতে অতি দরিদ্রদের বোঝাতো। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। চরাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফসল। জেগে ওঠা পলিমাটি, বালুচর কিংবা চরের অনাবাদি ভূমি এখন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষির অবারিত ক্ষেত্র হিসেবে। সারা বছরই কোনো না কোনো ফসল ও সবজির আবাদ হচ্ছে। 

এখন চরের মানুষদের জীবনধারায় এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। জমি তৈরি, বীজ বপন, পরিচর্যা কিংবা ফসল তোলার ব্যতিব্যস্ততা চরাঞ্চলের নৈমিত্তিক চিত্র। এর ফলে বেশির ভাগ চরেই দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। চরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে শাক সবজির চাষ করে বহু পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। শুধু ধান চাষের উপর নির্ভরশীল কৃষিতে শাকসবজির চাষ এনে দিয়েছে নতুন গতি। কৃষকদের জীবন জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কৃষির এই সফল বিবর্তন। 

অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন চরে পরিবেশ সম্মতভাবে সবজি চাষ বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চরের জমিতে সবজি চাষ করে কৃষকদের অভাব দূর হচ্ছে। প্রতি বিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করে বছরে ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা, ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি লাভ করতে পারছেন। এ প্রসঙ্গে একজন কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘সবজি উৎপাদন চরের কৃষকদের মাঝে নতুন এক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। কৃষকরা সবজি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন’।

অক্সফাম ইন বাংলাদেশের পলিসি, এ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন এ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার এসএম মনজুর রশীদ মনে করেন, দেশের চরের কৃষি অপার এক সম্ভাবনার জায়গা। কিন্তু বহুবিধ কারণেই চরের উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনায় এখনও নানা ধরনের জটিলতা বিদ্যমান। চরের কৃষিসেবা ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনীকিকরণের মধ্যে দিয়ে অধিক হারে খাদ্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা জাগিয়েছে চরাঞ্চলের কৃষি। দেশের একেকটি চর এলাকা যেন কৃষি-অর্থনীতির অবারিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র। পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হলে অথৈর্নতিক সমৃদ্ধির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিরাট ভূমিকা রাখবে চরাঞ্চল। 

এ নিয়ে একটি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘তবে চরাঞ্চলের জমি এবং কৃষক সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার। আধুনিক চাষবাস সুবিধা না থাকায় চরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন আশানুরূপ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর তাই চরের কৃষিজমি এবং কৃষকের প্রতি আরও নজর দেয়া এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে।’ 

শুধু চাষাবাদ নয়, চরাঞ্চলে আরেকটি সম্ভাবনার জায়গা হলো গবাদি পশুপালন। অনেকে এখন ছাগল, মহিষ, ভেড়া ও উন্নত জাতের গরু পালনের উদ্যোগ  নিয়েছে। এতে করে দুরকমভাবেই লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। কিন্তু দেশের সব চরে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদিত পণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ায় এখনো নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ফলে চরে যে বিস্তীর্ণ আবাদি জমি রয়েছে সেখানে সেই মাত্রায় অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চরাঞ্চলে নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তির অভাব, উন্নতমানের বীজের সঙ্কট, উন্নত জাতের ফসল চাষের প্রচলন না থাকা, সেচ সঙ্কট এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা এবং কৃষকদের দ্রুত ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা। অর্থনীতবিদরা মনে করেন এসব সংকট দুর করা গেলে চরাঞ্চলের অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারে।  

 কানাই/ ওআ/ আই.কে.জে/

চরাঞ্চল

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন