রবিবার, ৩রা আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন *** তারুণ্যের প্রথম ভোট ধানের শীষের জন্য হোক: তারেক রহমান *** গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপল্লিতে হামলাকারীদের উসকানি, স্থানীয় সাংবাদিক গ্রেপ্তার *** যাত্রীর লাগেজটি নড়ছিল, খুলতেই ভেতরে ২ বছরের শিশু *** তারেক রহমান আসবেন, আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, পথ দেখাবেন: মির্জা ফখরুল *** ১৮ তলা থেকে পড়ে বেঁচে গেল তিন বছরের শিশু *** ট্রাম্পের হুমকিতেও রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখবে ভারত *** নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর নির্বাচনী পর্ষদ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা *** এলপিজি ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম কমল ৯১ টাকা *** নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে বিএনপির কমিটি

‘এখন সাংবাদিকতা করা মানে নিজের নিরাপত্তাকে জুয়া হিসেবে দাঁড় করানো’

এসএম শামীম

🕒 প্রকাশ: ০৩:৩৬ অপরাহ্ন, ২রা আগস্ট ২০২৫

#

গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ—এই কথা শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি হয়ে উঠেছে কী না, তা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এখনই। একদিকে আইন ও নীতির কাগুজে সংস্কার, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত চাপ, মামলা ও হয়রানি—বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সম্প্রচার সাংবাদিকতা যেন টিকে আছে প্রতিরোধের দৃঢ়তায়, পেশাগত স্বাধীনতার গ্যারান্টি ছাড়াই।

বিশেষ করে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষের মনে যে আশাবাদের জন্ম হয়েছিল—সাংবাদিকতার জন্য একটা স্বাধীন ও নিরাপদ পরিসর তৈরি হবে—তা বাস্তবে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বরং নতুন কাঠামোর আড়ালে পুরনো দমননীতিই ফিরে এসেছে ভিন্ন মোড়কে।

গত মঙ্গলবার (৩০ শে জুলাই) জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক এবং তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমান তার ইউটিউব চ্যানেল ‘আমার কথা’য় আপলোড হওয়া এক ভিডিওতে এসব কথা বলেন। আজ শনিবার (২রা আগস্ট) দুপুরে এই প্রতিবেদন লেখা পযর্ন্ত তার চ্যানেলে ওই ভিডিওটি দেখেছেন ২৩ হাজার ৮২৮ জন দর্শক। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে কাজ করা এখন নিজের নিরাপত্তাকে প্রতিদিন জুয়া হিসেবে দাঁড় করানোর মতো।’

২৫০ এর বেশি মামলা, নিঃশ্বাস বন্ধ অনুসন্ধানে

জিল্লুর রহমান ওই ভিডিওতে জানান, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ২৫০টিরও বেশি মামলা হয়েছে। শুধু ফেসবুকে মতামত দিলেও মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্বপরিকল্পিত।

এই বাস্তবতায় অনেক সাংবাদিকই আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রায় বিলুপ্ত। রিপোর্ট তৈরি হয়, কিন্তু প্রকাশ হয় না—‘সত‍্য বলে ফেলবেন’ এই আশঙ্কায়।

বড় বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মালিক ও স্পন্সরের স্বার্থে চলে। পেশাদারত্ব সেখানে শুধু নীতিমালার পাতায় সীমাবদ্ধ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নতুন আইন, পুরনো ভয়

জুলাই আন্দোলনের পর সরকার বদলালেও আইনি কাঠামোতে তেমন কোনো বদল আসেনি বলে মনে করেন এই সাংবাদিক। আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের আগে-পিছে অপব্যবহারের বহু নজির আছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুরনো আইন বাতিল করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ জারি করলেও এর ৪২ ধারায় বলা হয়েছে—যদি নতুন আইনে কিছু উল্লেখ না থাকে, তাহলে পুরনো আইসিটি আইন, সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি বলবৎ থাকবে। অর্থাৎ, ‘পুরনো সব অস্ত্র নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে।’

এছাড়া নতুন আইনেও রয়েছে অস্পষ্ট ও ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ রাখা শব্দ—‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’, ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, ‘গুজব’, ও ‘জনমনে বিভ্রান্তি’। এসবের কোনো আইনি সংজ্ঞা না থাকলেও দমনমূলক ব্যবহারে এগুলোই যথেষ্ট হয়ে উঠছে।

সংস্কার আছে কাগজে, বাস্তবে নয়

জিল্লুর রহমান বলেন, সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন—ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় পরিবর্তন এনে অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে অভিযোগবিহীন ব্যক্তিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রমাণ মিললে বিচার করা যাবে। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এই আইনের ব্যবহার কি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষভাবে হবে?’

তিনি বলেন, মিডিয়া রিফর্ম কমিশন ‘ন্যাশনাল মিডিয়া অধ্যাদেশ ২০২৫’ ও ‘সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামে দুটি খসড়া প্রণয়ন করলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে দেওয়া সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাগুলোও ঝুলে আছে।

এই অবস্থায় সরকার আবার ১৯৭৪ সালের প্রেস কাউন্সিল আইনের ভিত্তিতে একটি নতুন কমিটি গঠন করেছে। ২৮শে জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত ওই কমিটিতে কিছু সদস্যের নাম এসেছে তাদের অজ্ঞাতেই—যেমন নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর।

এ বিষয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘একদিকে নতুন কমিশন, অন্যদিকে পুরনো প্রেস কাউন্সিল—দুটো একসঙ্গে চালানো হলে সেটাকে সংস্কার নয়, প্রতারণা বলা উচিত।’

মিডিয়ায় প্রভাবের রাজনীতি

জিল্লুর রহমান মনে করেন, সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোও রাজনৈতিক বিভাজনে আক্রান্ত। এক অংশ সরকারঘেঁষা, অন্য অংশ বিরোধীপন্থী। ফলে তারা সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা নিয়ে একজোট হতে পারছে না।

অন্যদিকে মিডিয়া মালিকরা অনেক সময় রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে লাইসেন্স বা কর সুবিধা পান, এমন অভিযোগও রয়েছে। কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেই শুরু হয় কর ফাঁকি, ট্রেড লাইসেন্স জটিলতা কিংবা তদন্ত কমিটির ঝড়।

তিনি বলেন, ‘এই অবস্থার সুযোগ নেয় প্রশাসন ও পুলিশ, যারা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে সাংবাদিকদের হয়রানি করেন।’

জিল্লুর রহমান মনে করেন, প্রতিটি মিডিয়া হাউসের উচিত একটি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী সম্পাদনা নীতিমালা থাকা, যাতে সাংবাদিকদের সুরক্ষা, আচরণবিধি এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকে।

তার কথায়, ‘যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে, তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এবং অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।’

‘গণমাধ্যম নিরাপদ না হলে গণতন্ত্রও নয়’

সাংবাদিকতা সংস্কারের প্রশ্নে সরকার এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে মনে করেন জিল্লুর রহমান। ‘জাতীয় ঐক্য কমিশনের আওতায় ছয়টি খাত নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু মিডিয়া কমিশনের প্রস্তাব তার মধ্যে নেই,’ বলেন তিনি।

জিল্লুর রহমান বলেন—‘শুধু আইন বা খসড়া বদলালে চলবে না, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আমলাতান্ত্রিক নীরবতা ভাঙার মানসিকতা এবং সবচেয়ে জরুরি—সাংবাদিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও ঐক্য।’

তার মতে, ‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তা শুধু তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। যতদিন না গণমাধ্যম নিরাপদ, ততদিন গণতন্ত্রও নিরাপদ নয়—এটা আমাদের মানতেই হবে।’

এসএমএস/

জিল্লুর রহমান

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন