ছবি: সংগৃহীত
ধর্মপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমাবেশে মানুষের কেন সমাগম হয়, এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি মনে করেন, মাদ্রাসার, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা পেয়েছে, তা তাদের উৎপাদনশীল কাজে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ চাকরিবাকরির জন্যও উপযুক্ত করে তোলেনি। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে এখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন নেই। নাটক, গান ও মেলা উঠে গেছে, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বাধাগ্রস্ত, সেখান আছে শুধু ওয়াজ। গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলকে এখন বিনোদনের ব্যাপার করে তোলা হয়েছে। ওই ওয়াজই সেদিন ভিন্ন আঙ্গিকে চলে এসেছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, হেফাজতিদের সমাবেশে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, সংস্কারের উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গঠিত ১১টি কমিশনের মধ্যে হেফাজতের নেতারা শুধু ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নারীর অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনে। সেই কমিশন অবিলম্বে ভেঙে দিতে হবে বলে তারা হুংকার দেন। এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি সরকারের দিক থেকে হেফাজতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করায় সমালোচনা করেন। দৈনিক আজকের পত্রিকায় লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন। 'হৃদয় ও মস্তিষ্ক দুটোই সংস্কৃতির প্রধান ভরসা' শিরোনামে তার এ লেখা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে আজ বৃহস্পতিবার (৩০শে জুলাই) প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩রা মে চার দফা দাবি আদায়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহাসমাবেশের মুখ্য চারটি দাবির মধ্যে ছিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল, সংবিধানের প্রস্তাবনায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ওই সমাবেশে নারীর বিরুদ্ধে যে ভাষা, ভাব ও ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা গেছে আলোচকদের, তেমনটা স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো শুনতে ও দেখতে হবে—এমনটা ইতিপূর্বে কল্পনাও করা যায়নি।
আজকের পত্রিকার কলামে তিনি বলেন, 'গ্রামাঞ্চলে এখন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম নেই বললেই চলে। শহরেই নেই, তো গ্রামে কেন আশা করব? নাটক নেই, গান নেই, মেলা উঠে গেছে, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বাধাগ্রস্ত; আছে শুধু ওয়াজ। ওয়াজকে এখন বিনোদনের ব্যাপার করে তোলা হয়েছে। বক্তারা জাঁকজমকের সঙ্গে, অনেক সময় হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে আসেন, বক্তৃতা করেন, টাকা নেন এবং চলে যান। রেখে যান তাদের বক্তব্যের অশালীন অংশের রেশ। পুরুষেরা আমোদ পান, মেয়েরাও মেনে নেন—এটাই স্বাভাবিক বলে। ওই ওয়াজই সেদিন ভিন্ন আঙ্গিকে চলে এসেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, হেফাজতিদের সমাবেশে।'
তিনি বলেন, 'সংস্কারের মহৎ উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গঠিত যে ১১টি কমিশন কাজ করছে, তাদের অন্য কোনোটির বিষয়েই হেফাজতিরা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কেবল একটির ওপরে; সেটি হলো নারীর অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সেই কমিশন অবিলম্বে ভেঙে দিতে হবে বলে তারা হুংকার দিয়েছেন। কমিশন অন্য কেউ গঠন করেনি, করেছে অন্তর্বর্তী সরকার নিজে। সেই কমিশন ভেঙে দিতে হবে—এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ আমরা শুনিনি।'
ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিমত, 'দেশে জামায়াতে ইসলামী আবার প্রকাশ্যে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। গুপ্ত অবস্থায় থেকে হিযবুত তাহ্রীরও তৎপর হয়ে উঠেছে। লক্ষ করা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের কাজকর্মও। তাদের সমাবেশে লোকের কোনো অভাব ঘটে না; কারণ মাদ্রাসার, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার বর্তমান ও অতীতের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল এবং এখন তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। যে শিক্ষা তারা পেয়েছে, তা তাদের উৎপাদনশীল কাজে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ চাকরিবাকরির জন্যও উপযুক্ত করে তোলেনি।'
তিনি লেখেন, 'দারিদ্র্যের ও বেকারত্বের দুঃসহ চক্রের ভেতরেই তারা থাকে (মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা) এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ডাক পড়লে ভালো কাজ পেয়েছে বলে পিলপিল করে বিপুল পরিমাণে এসে হাজির হয়। সম্প্রতি তাদের এক সমাবেশে উদারনীতিকদের তো বটেই, মেয়েদের বিরুদ্ধেও যে ভাষা, ভাব ও ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা গেছে, তেমনটা স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো শুনতে ও দেখতে হবে—এমনটা ইতিপূর্বে কল্পনাও করা যায়নি, বিশেষ করে সেই উদ্যানে, যার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং যেটি বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকারই একটি অংশ।'
খবরটি শেয়ার করুন