ছবি: সংগৃহীত
একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি বিষয়ের সুরাহা চেয়েছে ঢাকা। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ই এপ্রিল) ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ এ বিষয়ে জোর দিয়েছে। পাকিস্তান বিষয়গুলো সুরাহার জন্য 'আলোচনার সদিচ্ছা' ব্যক্ত করেছে। দুই দেশের 'সম্পর্কের মজবুত ভিত্তির স্বার্থে' অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি বৈঠকে। এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন এবং অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব মতে, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো ২০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা অন্যতম। এ ছাড়া আছে বিদেশি ঋণ, যা বাংলাদেশে ব্যয় হয়নি; কিন্তু স্বাধীনতার পর দায় নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
এ ছাড়া স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রের অর্থ ফেরত দেয়নি।
আজ ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতার আগের পাওনা ৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন বলেন, এসব বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ‘সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছে পাকিস্তান’। অনেকের প্রশ্ন, পাকিস্তান কী বাংলাদেশের পাওনা ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার আদৌ পরিশোধ করবে?
আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, 'এ দাবি আমরা আগেও করেছি। কিন্তু পাকিস্তান দেয়নি। তারপরও আমাদের দাবি জানিয়ে যেতে হবে। আমাদের সম্পদ তো আমরা চাইবোই।'
তিনি বলেন, '১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি গণহত্যার জন্য পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ক্ষমা চায়নি। বাংলাদেশের মানুষের একটা প্রত্যাশা যে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবে। একাত্তরে তাদের যে ভূমিকা, সেটার দায় তারা গ্রহণ করবে। সেটা হলে দুই দেশের সম্পর্কের পথ আরো প্রশস্ত হবে।'
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক ১৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে এতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, 'এখন দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য যেসব কাজ বা করণীয়, সেগুলো আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক করে একটা কমন গ্রাউন্ড তৈরি করাই হবে এবারের বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য।'
হুমায়ুন কবির বলেন, 'বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন সব জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নিয়েই দুই দেশের কাজের সুযোগ আছে।'
তার মতে, 'বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একই অঞ্চলের এবং সার্কের সদস্য। যোগাযোগের ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি থেকে দুই দেশই লাভবান হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে, যা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে। পর্যটনও হতে পারে দুই দেশের নতুন ক্ষেত্র। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর উপায় খুঁজতে হবে আলোচনার টেবিলেই।'
উল্লেখ্য, এর আগে জাতিসংঘের সম্মেলনের সময়ে সাইডলাইন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যাপক ইউনূসকে অভিনন্দন জানান শাহবাজ শরিফ।
এর এক মাসের মাথায় গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইনে দু'জনের মধ্যে বৈঠক হয়, সেখান থেকেই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জট খোলার ইঙ্গিত আসে। ঢাকা ও ইসলামাবাদ- উভয় দেশের কূটনীতিকরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
এরপর নভেম্বরেই পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এলে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরপর থেকে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়ানোর বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে আসে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল প্রায় ৭৯ শতাংশ।
বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মূল্য ছিল ৬ কোটি ডলারের সামান্য বেশি। মূলত কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
সম্পর্ক স্বাভাবিক গতিতে এগোতে পারলে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য আরও কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব, যাতে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের বিষয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন জানান, বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি ২৭শে ও ২৮শে এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন।
এইচ.এস/