ছবি: সংগৃহীত
নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী, যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত। কবি নির্মলেন্দু গুণ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ১৯৪৫ সালের ২১শে জুন নেত্রকোনার বারহাট্টার কাঁশবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এবং মাতা বীণাপাণি। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ সবার ছোট।
চার বছর বয়সে মাতার মৃত্যুর পর তার পিতা আরেকটি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় মায়ের কাছেই নির্মলেন্দুর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। প্রথমে বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে দুই বিষয়ে লেটারসহ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন।
মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কাণ্ডারী’। মেট্রিকের পর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে আইএসসি পড়তে চলে আসেন। মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপসহ নিয়ে পড়তে থাকেন।
নেত্রকোনায় ফিরে এসে নির্মলেন্দু গুণ আবার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় লেখালেখি ও তার কবি বন্ধুদের কাছে আসার সুযোগ পান। নেত্রকোনার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে তার দিন ভালোই কাটতে থাকে। ১৯৬৪ সালে আইএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ পান। তাদের মধ্যে তিনিও একজন।
বাবা চাইতেন ডাক্তারি গুণকে পড়াতে। কিন্তু না, তিনি চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)৷ ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ৷ হঠাত্ ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে যান গ্রামে। ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তার নাম ভর্তি লিস্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে গ্রামে ফিরে আসেন৷ আইএসসি’তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা। তখনকার দিনে সেটা অনেক টাকা ছিল। ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন।
তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯-৭০ সালের উত্তাল গণআন্দোলন ও বাংলাদেশের জন্মের প্রাক্কালে, যখন সব কিছু ভেঙে পড়ছে, তখন যে নায়ক-চরিত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, ঠিক সে সময়ে তিনি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ রচনার মাধ্যমে তা পূরণ করেন।
কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন ও ছবি এঁকেছেন। তার কবিতায় মূলত নারীপ্রেম, শ্রেণি-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে। তার বিখ্যাত কাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- হুলিয়া, অসমাপ্ত কবিতা, মানুষ, প্রেমাংশুর রক্ত চাই, আফ্রিকার প্রেমের কবিতা ও নিরঞ্জনের পৃথিবী ইত্যাদি।
স্বদেশপ্রীতি তার কাব্যরচনার অন্যতম অনুপ্রেরণা। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে যখনই বিপর্যয় এসেছে, ততবারই তিনি কলম তুলে তার ক্ষোভ ও দ্রোহ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে যে ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার হয়েছেন, তিনি ছিলেন সবার থেকে অগ্রগণ্য।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে অবলম্বন করে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি সারা জীবনের কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ২০০১ সালে একুশে পদক পুরস্কার পান।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাগুলো বাঙালির আবেগ-অনুভূতিকে জাগরিত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ছন্দময়তার পরিবর্তে গদ্য কবিতা সহজভাবে পাঠকের হৃদয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেকে বাঙালির আধুনিক প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কবির জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
খবরটি শেয়ার করুন