ছবি: সংগৃহীত
মব সন্ত্রাস কোনোভাবে থামছে না। দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা বা মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দিনদিন বেপরোয়া হচ্ছে। সাধারণ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের মধ্যেও মবের উদ্বেগ, আতঙ্ক। যেন কেউ নিরাপদ নন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা এবং লালমনিরহাটে ধর্ম ‘অবমাননার’ অভিযোগে পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে হেনস্থা করার দুটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, কিন্তু তাদের সামনে অপরাধীরা মব করে অবাধে চলে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মবের শিকার হচ্ছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, গত ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে ও গণপিটুনিতে সারাদেশে ১৭৪ জন মারা যান। একের পর এক মব সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও এর মোকাবিলায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং, সরকারের দায়িত্বশীল পদে থাকা কারও কারও বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
যে কোনো মব ঘটনার পরই সরকারের বিবৃতি ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ তেমন নেওয়া হয় না। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একাধিকবার মবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। খোদ পুলিশ সদস্যরা এখনও মবের শিকার হচ্ছেন। আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া ও বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও, হামলা করা হচ্ছে।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা দৃশ্যমান নয়। বস্তুত এ ব্যাপারে সরকারকে এক ধরনের নির্বিকার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও মব জাস্টিসের কোনো কোনো ঘটনায় সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে।
এটা ঠিক, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবলে চির ধরেছিল, তারা নিষ্ক্রিয় ছিল বেশ কিছুদিন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা আবার কর্মস্থলে ফিরে এসেছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। রয়েছে আনসার বাহিনী।
গত বছরের আগস্টে যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা কিংবা মব সহিংসতার কারণ হিসেবে পুলিশ নিষ্ক্রিয় বলে দোহাই দেওয়া হতো। দশ মাস পরও সেই অজুহাত কোনোভাবে চলে না; যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, সেনাসদস্যরাও নিয়োজিত।
কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ আইনি প্রক্রিয়া। বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি-অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু বিগত দশ মাস ধরে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে যেন মব চলছে। কে মবের শিকার হবেন, কারা হামলা চালাবেন, কে মামলা করবেন, কে ভিডিও করবেন– সব যেন পরিকল্পিত।
সরকার কত বাহিনী নিয়ে কত প্রকার অভিযান চালাচ্ছে, সেই হিসাব জনগণ জানতে চায় না। তারা চায় জানমালের নিরাপত্তা। ঘটনার পেছনে না দৌড়ে সরকারের উচিত শক্ত হাতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, মব সহিংসতার নামে দেশব্যাপী যে অরাজকতা চলছে, তা বন্ধ করতেই হবে।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। সংবিধানও সে কথাই বলে। কাজেই এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। মব জাস্টিসসহ সব ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করে সরকার দেশে অচিরেই স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবে, এটাই কাম্য।
খবরটি শেয়ার করুন