সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক চলছে। ঘটনার সূত্রপাত, ‘আয়না ঘর’ থেকে মুক্তি পেয়ে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী এক সংবাদ সম্মেলনে সংবিধানের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে। সে কারণেই তার বক্তব্যকে অনেকেই হালকা করে দেখছেন না। আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি আমান আযমীর নিজস্ব বক্তব্য। দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি এবারই নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, যারা ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী তারা মাঝে মাঝেই সুযোগ বুঝে এই দাবি করে থাকে। এটা তাদের যতটা না জাতীয় সংগীতের বিরোধিতা, তার চেয়ে বেশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা কেন জাতীয় সংগীত হবে এখানেই তাদের ঘোর আপত্তি। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী যতই জাতীয় সংগীতের বিরোধিতা করেছে ততই আমাদের প্রাণের সংগীত স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা গান হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' অলিম্পিকে বাজানো সব দেশের জাতীয় সংগীতের একটা র্যাংকিং করা হয়েছিল সেখানে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি' গানটি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিয়েছে।
জাতীয় সংগীত বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। সেখানেই গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় মুক্তিযোদ্ধারা এই গানটি গেয়ে যুদ্ধ করেছেন। প্রেরণা পেয়েছেন, শক্তি পেয়েছেন।
তবুও মাঝে-মধ্যে এক শ্রেণির ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই গান নিয়ে বিতর্ক করেন। যারা বিতর্কটা করেন, তারা মূলতঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বর্জন করতে চেয়ে সুকৌশলে জাতীয় সংগীতের কথাটা বলেন। যারা বিতর্কটা তৈরি করেন তাদের উদ্দেশে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের লেখাটা যথার্থ প্রযোজ্য। তিনি লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ- যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠেনি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সংগীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠেন।’
আই.কে.জে/