ফাইল ছবি (সংগৃহীত)
সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন দেশের সড়কগুলোতে নিহত হচ্ছেন ১৪ জনের বেশি মানুষ। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব কিংবা লম্বা কোনো ছুটির সময়ে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজপথ হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। যে কোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে সে মৃত্যু যদি হয় দুর্ঘটনায়, তাহলে বেদনার মাত্রা বেড়ে যায়। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ।
ঘর থেকে বের হয়ে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকে লাশ হয়ে ফিরছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের শয্যায় অনেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অসংখ্য মানুষ। একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি হারিয়ে গেলে শুধু প্রিয়জন হারানোর বেদনা নয়, সেই পরিবারের প্রতিদিনের দুঃখ বেদনায় সমাজ ও রাষ্ট্র কেবলই দর্শক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, যানবাহনের যান্ত্রিক ক্রটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, গাড়ির প্রতিযোগিতাসহ নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসে সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৭৪৩টি দুর্ঘটনায় ৭৮০ জন নিহত এবং ১ হাজার ৯১৬ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, জুন মাসে দেশে মোট ৬৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৯৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৮৬৭ জন আহত হয়েছেন।
যা আর্থিক মূল্যে মানবসম্পদের প্রায় ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে সারাদেশে ২ হাজার ৪৮২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২ হাজার ৩৭৭ জনের মৃত্যু এবং ২ হাজার ৮২২ জন আহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির দেড় থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত যারা হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাদের মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ পরিবারের জন্য দুঃসহ ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হওয়া সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে বিআরটিএ, পুলিশ, সড়ক বিভাগ কারও কোনো গা নেই।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। দেশে বিভিন্ন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়। যেমন সড়কের পাশে বাজার ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো। একই সঙ্গে রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, অরক্ষিত রেলক্রসিং, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে যাওয়াকেও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক, হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএকে যৌথভাবে দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিয়োজিত অসংখ্য অদক্ষ চালক ও হেলপার, পরিবহন ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে দিনদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। দুর্ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়ক–মহাসড়ককে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে সঁপে দিয়ে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের চাপে সড়ক পরিবহন আইনকে সংশোধন করে আইনটিকে যেভাবে নখদন্তহীন বাঘে রূপান্তরিত করা হয়েছে, সেটা বরং সড়কে নৈরাজ্য বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার বিকল্প কী আছে? সড়কে নাগরিকের হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
খবরটি শেয়ার করুন