ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান। ছবি: সংগৃহীত
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ রোববার (২২শে জুন) ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এ অস্থিরতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মোদি অবিলম্বে উত্তেজনা কমানো এবং সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। খবর এনডিটিভির।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, ৪৫ মিনিটের এ ফোনালাপের উদ্যোগ এসেছিল ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের কাছ থেকে। আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরেই তিনি এ উদ্যোগ নেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেন এবং ভারতকে আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র ও অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করেন।
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ভারতের অবস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ধন্যবাদ জানান এবং উত্তেজনা কমানো, সংলাপ ও কূটনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমি সাম্প্রতিক উত্তেজনার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছি।’
এ ফোনালাপ হয়েছে এমন এক সময়, যখন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা—নাতানজ, ইস্পাহান ও মাটির নিচে অবস্থিত ফোরদোতে হামলা চালিয়েছে আমেরিকা। ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
আমেরিকা ও তাদের মিত্রদেশগুলোর দাবি, ইরান যে কোনো মুহূর্তে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে। অনেক দেশকে এমনও বলতে শোনা গেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে।
আজ স্থানীয় সময় ভোরে ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় কমপক্ষে ছয়টি বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান হামলা চালায়। এ ছাড়া নাতানজ, ইস্পাহানে আঘাত হানে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এ হামলার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ইরানকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘হয় শান্তি আসবে, নয়তো ইরানের জন্য এমন ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে, গত আট দিনে আমরা যা দেখেছি, তার চেয়ে ভয়াবহ হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান এ সংঘাত কোনো কারণে বেড়ে গেলে ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যেমন ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনের বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
২০২৫ অর্থবছরে ভারতে ইরানের রপ্তানি ছিল ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বাসমতী চাল (৭৫৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার), কলা (৫৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার), সয়া মিল (৭০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার), ছোলা (২৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার) এবং চা (২৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার) ছিল প্রধান পণ্য। গত অর্থবছরে আমদানি ছিল ৪৪১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের রপ্তানি ছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (২০২৪-২৫)। এর থেকে বোঝা যায়, ভারত ইসরায়েল ও ইরান—উভয় দেশের সঙ্গেই শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখে।
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক এ সংঘাত লোহিতসাগর দিয়ে কার্গো চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, হুতি বিদ্রোহীরা বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। গত বছর ইয়েমেনভিত্তিক হুতি জঙ্গিদের আক্রমণের কারণে বাব-এল-মান্দেব প্রণালির (লোহিতসাগর ও ভূমধ্যসাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুট) পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
ইউরোপের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য বাণিজ্য লোহিতসাগর দিয়ে হয় এবং আমেরিকার সঙ্গেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্য এ পথেই চলে। এই দুটি অঞ্চল থেকে ভারতের মোট রপ্তানির ৩৪ শতাংশ আসে। লোহিতসাগর বৈশ্বিক কনটেইনার ট্রাফিকের ৩০ শতাংশ এবং বিশ্ববাণিজ্যের মোট ১২ শতাংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ইতিমধ্যে জানিয়েছে, শুল্কযুদ্ধের প্রভাবে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির পরিবর্তে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কমবে। এ পরিস্থিতিতে ভারত কীভাবে তাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
খবরটি শেয়ার করুন