ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্যান্য খাতের মতো মৎস্য খাতও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। মাছের উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে রফতানি আয়ও। এমনকি করোনা মহামারিতেও মাছের উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের এমন অর্জনে সরকারের পাশাপাশি উচ্ছ্বসিত সাধারণ মানুষও।
চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, ইলিশে প্রথম
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুয়ায়ী বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি মাছ চাষ হয় ময়মনসিংহে।
উৎপাদন বেড়েছে ছয় গুণের বেশি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন) চেয়ে ৫৫ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে আরো জানা গেছে, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৩৮ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ছয় গুণের বেশি।
করোনার সময়েও এসেছে সাফল্য
করোনা মহামারিতেও মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেয়া তথ্যানুসারে করোনার মধ্যে বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৯২ শতাংশ
সরকারের নানামূখী উদ্যোগে ইলিশের উৎপাদন আশাতীতভাবে বেড়েছে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে ১৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, ইলিশের বর্তমান উৎপাদন ৫ লাখ ৭১ হাজার টন বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান।
সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫ শতাংশ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কি.মি এলাকায় বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সমুদ্রে স্থায়ীত্বশীল মৎস্য আহরণের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। অপরদিকে সামুদ্রিক মাছের অবাধ প্রজনন, সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে সমুদ্রে প্রতিবছর ২০শে মে থেকে ২৩শে জুলাই পর্যন্ত সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলস্বরুপ সমুদ্রে মাছের উৎপাদন ১২-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি তথ্য সার্ভিস।
বেড়েছে রফতানি আয়
মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের রফতানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে ৬৯ দশমিক ৮৮ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৪২ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি আয় ছিল ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
উল্লেখ্য, বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে বাংলাদেশের মাছ রফতানি হচ্ছে।
অবদান রাখছে জিডিপি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান তৈরিতে
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ এই খাত। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়া দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
সরকারি ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪১ সালে দেশে মাছের উৎপাদন দাঁড়াবে ৯০ লাখ মেট্রিক টন।
যেভাবে এলো সাফল্য
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই সময়ে মাছের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য খাতে গবেষণার উন্নয়ন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের মৎস্য খাতে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাটকা আহরণে বিরত থাকা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭১টি জেলে পরিবারকে ৪ মাসে ৫৭ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন ভিজিএফ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩১ হাজার ৭০০ জেলেকে চাহিদানুযায়ী নানা উপকরণ প্রদান করা হয়েছে।
মৎস্য খাতের উন্নয়নে গবেষণাও বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহের পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা) ড. মো জুলফিকার আলী জানান এখন পর্যন্ত ৪০টি বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের জাত উন্নয়ন ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক। সেখানে এখন পর্যন্ত ১০২ প্রজাতির মাছ সংরক্ষিত আছে।
সাফল্যে খুশি সরকার
ইলিশের উপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের বর্তমান ভূমিকা কী এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ইলিশ বেড়ে উঠার পথে কোনোভাবেই যাতে বাধা সৃষ্টি না হয় সেজন্য যা যা করা দরকার আমরা করবো।
মন্ত্রী আরো বলেন, ইলিশের উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আশা করছি ভবিষ্যতে এটা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করবে। ইলিশ উৎপাদনকারী দেশসমূহের মধ্যে আমরা প্রথম স্থানে রয়েছি। জাটকা রক্ষায় ও মা ইলিশ আহরণ বন্ধে জলে, স্থলে ও আকাশপথে বিভিন্নভাবে মনিটর করা হচ্ছে। ইলিশের অভয়াশ্রমে জাটকা নিধনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যারা কারেন্ট জাল, বেহুন্দী জালসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জাল তৈরি করে জাটকা নিধন করে তাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রদান ও জরিমানা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এক বিবৃতিতে বলেন, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে এটি দ্বিতীয় অবস্থানে উন্নীত করতে হবে।
খুশি সাধারণ জনগণও
আব্দুর রহিম পেশায় একজন আইনজীবী। সংসারের প্রধান হিসেবে তিনি নিজেই বাজার-সদাই করে থাকেন। গত ২০ বছরের মাছ কেনার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘এখন আগের চেয়ে মাছের প্রাপ্যতা বেড়েছে। এর মূল কারণ হলো এখন চাষের মাছ বেশি পাওয়া যায়। আগে হাওর, পুকুর, বিলের মাছের ওপর বেশি নির্ভর করতে হতো। ফলে মাছের দামও তুলনামূলক বেশি ছিল।’
তবে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ইলিশের মৌসুমেও বেশি দামে কিনতে হয়। এই ব্যাপারে সরকারের আরো কঠোর হওয়া উচিত। মাছ চাষ আরো বিস্তৃত হলে সাধারণ মানুষ আরো সাশ্রয়ীমূল্যে আমিষ জাতীয় খাবার কিনতে পারবে।’
আছে চ্যালেঞ্জও
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হলেও এখন মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তা ধরে রাখা। সে জন্য ভালো মানের পোনা ও মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে।