সোমবার, ২রা জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনা যাকে ঢাকায় ‘হত্যা’ করলেন, তিনি ময়মনসিংহে জীবিত!

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৪:৫৭ অপরাহ্ন, ৩১শে মে ২০২৫

#

সোলাইমান হোসেন সেলিম বেঁচে আছেন। জুলাই আন্দোলনে তাকে ‘শহীদ’ দেখিয়ে ‘হত্যা মামলা’ হয়েছে। এ মামলার প্রধান আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

মামলায় ‘নিহত’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পর কোনো মানুষ যখন নিজের পায়ে থানায় হাজির হয়ে বলেন, ‘আমি মরিনি, বেঁচে আছি’—তখন তা শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং দেশের বিচার ব্যবস্থা ও তদন্ত প্রক্রিয়ার বড় ব্যর্থতা তুলে ধরে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ব্যবসায়ী সোলাইমান হোসেন সেলিমকে জীবিত থাকা অবস্থায় ‘হত্যাকাণ্ডের শিকার’ বানিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছেন তারই সহোদর ও বড় ভাই গোলাম মোস্তফা মস্তু। 

এ মামলার আসামির তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছেন জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মামলায় তার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৪১ জনের নাম যুক্ত করে অজ্ঞাত আরও ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার পেছনে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে সংঘাত এবং তা থেকে উদ্ভূত ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে পদ্ধতিগত দুর্বলতা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।

২০২৪ সালের ৩০শে আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় দাখিল করা ওই মামলায় বলা হয়, রাজধানীর কাজলা এলাকায় ৩রা আগস্ট সেলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অথচ সেলিম তখন দিব্যি জীবিত ছিলেন এবং ময়মনসিংহের ধামর বেলতলি বাজারে নিজের মুদি দোকান সামলাচ্ছিলেন। ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় তাকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ’ দেখানো হয়।

বিবিসি বাংলা জানায়, ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া এলাকার সোলায়মান সেলিম নামের এক ব্যক্তি দাবি করছেন, জুলাই আন্দোলনে তাকে মৃত দেখিয়ে হত্যা মামলা হয়েছে। তার ঠিকানায় পুলিশ তদন্তে গেলে নিজের ‘ভুয়া মৃত্যু’ ও হত্যা মামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কা থেকে স্থানীয় থানায় সম্প্রতি একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন সেলিম।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এ মামলার নেপথ্য কারণ পারিবারিক জমি সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিরোধ। প্রায় ২০ বছর আগে তাদের বাবা আব্দুল হাকিম মারা গেলে জমি নিয়ে বিরোধ বাধে চার ভাইয়ের মধ্যে। সেলিমের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায়, তার সহায়-সম্পত্তির উপর চোখ পড়ে অন্য তিন ভাইয়ের। তাদের মধ্যে বয়সে সবার বড় ও ভয়ঙ্কর চরিত্রের অধিকারী হলেন মস্তু, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘ডাকাত মস্তু’ হিসেবে পরিচিত।

এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাকে মামলায় তারা মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই মেরে ফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একটু সতর্ক হয়েছি। কিন্তু পুলিশ কেন কীভাবে একটি ভুয়া মামলা নিল?’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা এবং ডিবি অফিসে গিয়েছি। আমি যে মরি নাই, এটা প্রমাণ করতেই বেগ পোহাতে হচ্ছে।’

সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলছেন, সেলিমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ নাটক সাজিয়েছেন তারই তিন ভাই। এর আগেও তারা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রাণে বাঁচেন। এ ঘটনায় সেলিম ২০২২ সালে হেলাল উদ্দিন ও আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেছিলেন।

ধামর বেলতলি বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে দোকান ও বসতবাড়ি গড়ে সেখানে বসবাস করছেন সেলিম। তার অভিযোগ, বড় ভাই মস্তু গত ১৫ বছর ধরে এলাকায় অনুপস্থিত থেকেও অন্য দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তার সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা করছেন। যেখানে একজন জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে হত্যা মামলা হয়, সেখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল—পুলিশের ভূমিকা কী ছিল? কেন তারা যাচাই না করেই মামলা নিল?

এ প্রশ্নের জবাবে ফুলবাড়িয়া থানার ওসি মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মস্তু একজন স্বীকৃত ডাকাত। তার নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি ও একটি মারামারির মামলা আছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকায় আসেন না। সম্ভবত সম্পত্তি দখল ও সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায়ের জন্যই এমন ভুয়া মামলা করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছি। এখন তারা বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী জোনের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাদী গোলাম মোস্তফা পলাতক, তার মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ, কোথায় আছেন, সেটাও জানা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশে ভাইদের মুখোমুখি করে ডিএনএ পরীক্ষাও করা হবে।’

এ ধরনের ভিত্তিহীন মামলা কীভাবে নেওয়া হলো, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। এসআই আমিনুল বলেন, ‘এ মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা আমি। এখন পর্যন্ত একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত তদন্ত শেষ করতে।’

বাদী মস্তুর অন্য দুই ভাই—হেলাল উদ্দিন ও আবুল হোসেন—মামলায় সাক্ষী হিসেবে থাকলেও তারা এর সঙ্গে ‘দূরত্ব’ প্রকাশ করছেন। হেলালের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, ‘শুনেছি মামলার কথা। বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো, তা জানি না। মস্তু কাকা যদি কিছু করে থাকেন, তাহলে সেটা তার কাজ।’

এ পরিবারে দীর্ঘদিনের বিরোধের সাক্ষী স্থানীয় রুহুল আমিন বলছেন, সেলিম নিরীহ মানুষ, দোকান করে খায়। ছেলে সন্তান না থাকায় ভাইয়েরা জমি আগেভাগেই পেতে চায়। কিন্তু একজন জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে মামলা করা—এটা তো চরম পর্যায়ের ষড়যন্ত্র। যারা করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।

এইচ.এস/



শেখ হাসিনা

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন