ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে নানাভাবে আলোচিত ও প্রভাবশালী সাংবাদিক ছিলেন তারা। গোলটেবিল বৈঠকে, আলোচনা সভায়, টিভি চ্যানেলের টকশো অনুষ্ঠানে, দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতায় ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের মতামত বিভাগে তাদের সরব উপস্থিতি থাকত। এখন তারা দৃশ্যপটে নেই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ একাধিক হত্যা মামলার আসামি। আছেন কারাগারে, কেউ কেউ বিদেশে 'পালিয়েছেন’, অনেকে আছেন 'আত্মগোপনে'। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গত সরকারের শাসনকালে ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের’ অভিযোগ আছে।
কেউ কেউ চাকরিচ্যুত হয়েছেন ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী’ অভিযোগে, কেউ কেউ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই স্বেচ্ছায় কর্মস্থলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে 'নিরাপদ দুরত্বে' চলে গেছেন। তাদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য অধিদপ্তর।
এক সময় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাত-দিন তারা সরব থাকলেও এখন সেসব এড়িয়ে চলছেন।
আবার অনলাইনকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিতি থাকলেও রাজনৈতিক ও বিদ্যমান বাস্তবতা বিষয়ক আলোচনায় অনেকে অংশ নিচ্ছেন না। শুধু মূলধারার সংবাদমাধ্যমেই নয়, সামাজিক মাধ্যমেও তারা তেমন আলোচনায় নেই।
সুখবর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনামলে বেশি আলোচিত সাংবাদিকদের মধ্যে পাঁচজন কারাগারে আছেন। ৫ই আগস্টের পর বিদেশে 'চলে যাওয়ার' সুযোগ পেয়েছেন অন্তত ছয়জন। বাকিরা আছেন 'নিরাপদ দুরত্বে'। অনেকের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র সুখবরকে নিশ্চিত করতে পারেনি।
অন্তত তিনজন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ সুখবরকে এসব প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর তিনটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ১৯৭৫, ১৯৯০ ও ২০২৪ সালে। আগের দুটি অভ্যুত্থানের পর এবারের (২০২৪) মতো সাংবাদিকদের একটা অংশের বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ সামনে আসেনি।’
তারা বলেন, ‘সাংবাদিকদের এভাবে হত্যা মামলার আসামি হওয়ার রেকর্ডও দেশে নেই। গণহারে তাদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও আগে কখনো বাতিল হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক সমাজের আত্ম-বিশ্লেষণের দরকার আছে। আবার সাংবাদিকসহ যে কোনো পেশাজীবীদের বিরুদ্ধেই ঢালাও অভিযোগ সমর্থন করা যায় না।’
গত বছর ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভিত্তিহীন হত্যা মামলা নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে জুলাই-আগস্ট হত্যা মামলায় ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের নাম আসার বিষয়টি ‘পুরোনো আইন ও চর্চার ফল’ বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তড়িঘড়ি করে মামলা করতে গিয়ে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার এ ‘স্বীকারোক্তিকে’ স্বাগত জানায় প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ)।
আলোচিত সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম নাঈমুল ইসলাম খান। যিনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। সরকারের পতনের কারণে এই পদে তিনি থাকতে পারেননি। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন পতনের পর থেকে তিনি আছেন 'নিরাপদ দুরত্বে', বা 'আত্মগোপনে'।
আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও আমাদের সময়ের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাঈমুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হওয়ার আগে ছিলেন আমাদের নতুন সময় পত্রিকার ইমেরিটাস সম্পাদক।
গণঅভ্যুত্থানের পর ‘নিরাপদ দুরত্বে’ থাকা অবস্থায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নাঈমুল ইসলাম কুমিল্লার কান্দিরপাড় মৌজার বাগিচাগাঁও এলাকায় জমি বিক্রি করেন। একটি অংশের পরিমাণ এক দশমিক ৭৫ শতাংশ ও অন্যটির পরিমাণ দুই শতাংশ বলে সূত্র নিশ্চিত করে সুখবরকে।
আলোচিত সাংবাদিকদের মধ্যে আছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক নঈম নিজামের নাম। তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি। নঈম নিজাম ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত ‘ডামি নির্বাচনে’ কুমিল্লা-১০ সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তবে পাননি।
তার স্ত্রী পরে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হন। ফরিদা ইয়াসমিন ‘ওমেননিউজ২৪ ডটকমের’ সম্পাদক ও প্রকাশক। ৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নঈম নিজাম ও তার স্ত্রী বিদেশে চলে যান।
কাছাকাছি সময়ে দেশ ছাড়তে সমর্থ হন আওয়ামী লীগের আমলে টকশোর নিয়মিত মুখ ও ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম। ধারণা করা হচ্ছে, তার অবস্থান এখন আমেরিকায়।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ.ই. মামুন, এটিএন নিউজের বার্তাপ্রধান প্রভাষ আমিন, সময় টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমেদ জোবায়ের, বৈশাখী টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, বৈশাখী টিভির বার্তা প্রধান অশোক চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিস ঘোষ সৈকত, প্রণব সাহা (সবশেষ কর্মস্থল ডিবিসি), জায়েদুল আহসান পিন্টু, জুলফিকার আলী মানিক ও গাজী টিভির এডিটর রিসার্চ অঞ্জন রায় ৫ই আগস্টের পর চাকরিচ্যুত হন।
দেশে থাকলেও তারা এখন কোনো টকশোর অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ পান না। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় তাদের লেখা ছাপা হয় না।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ভারতের দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারির (প্রেস) দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক সাংবাদিক নেতা শাবান মাহমুদ। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সাবেক মহাসচিব শাবানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি আর দেশে ফেরেননি। ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা, তিনি ভারত থেকে ইউরোপের কোনো দেশে চলে গেছেন।
সাংবাদিক, উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা ও নবনীতা চৌধুরী আছেন বিদেশে। কলামিস্ট মাসুদা ভাট্টির সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা করে আরো আলোচিত হন মাসুদা ভাট্টি।
২০১৮ সালের ১৬ই অক্টোবর বেসরকারি একটি টেলিভিশনের টকশোতে কথা বলার একপর্যায়ে মইনুল হোসেন দৈনিক আমাদের অর্থনীতির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সম্পাদক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর ১৮ই অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক জানান, ‘মইনুল হোসেন প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে টকশো ও আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ইস্যুতে সরব ছিলেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেমবরের মাঝামাঝি থেকে তিনি বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আছেন।
মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত গত ১৬ই সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্ত এলাকায় আইনশঙখ্লা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আটক হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন।
মোজাম্মেল একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড, বাংলাদেশের সভাপতি আর শ্যামল দত্ত দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি কারাগারে থাকা অবস্থাতেই ভোরের কাগজের প্রকাশনা বন্ধের ঘোষণা দেয় মালিকপক্ষ।
একাত্তর টেলিভিশনের চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও প্রধান প্রতিবেদক, উপস্থাপক ফারজানা রুপা ২০২৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন।
এইচ.এস/