বৃহস্পতিবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** কিশোরগঞ্জের ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পেলেন সাবেক লাক্স সুন্দরী *** ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে ‘বর্ণবাদের দুর্গন্ধ’ *** আগামীকাল সকালে দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন জোবাইদা রহমান *** তেলের দাম বাড়ানো ব্যবসায়ীদের ‘কারণ দর্শানোর’ নোটিশ দিয়ে বৈঠকে ডেকেছে সরকার *** ৭ দিন নীরবতার পর ইমরানের টুইট, ভেঙে দিলেন দলের রাজনৈতিক কমিটি *** তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে দৃশ্যমান দ্বিধা ও অদৃশ্য বাধা *** আরও ৩৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা *** খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন ১৪ জন, থাকবেন পুত্রবধূ শামিলা, ছয় চিকিৎসক *** অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ বৈধ, আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় বহাল *** দেশে আসছেন জোবাইদা রহমান, খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি

সাংবাদিকদের নিয়ে মির্জা ফখরুলের মন্তব্য ও দলীয় সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৮:৩৯ অপরাহ্ন, ২৭শে নভেম্বর ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

শংকর মৈত্র

কয়েক দিন আগে সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেন, 'সাংবাদিকদের অনেক ইউনিয়ন আছে। আবার দুই দলে দুই ভাগ, তিন ভাগ আছে। তারা নিজেরাই দলীয় হয়ে যাচ্ছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কাউকে পকেটে নিতে চায় না, কিন্তু তারা যদি পকেটে ঢুকে যান, সেটা বড় সমস্যা' (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫.১১.২৫)।

সাংবাদিকদের নিয়ে দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ এই রাজনীতিবিদের নির্মোহ পর্যবেক্ষণ শুনে আমার নিজের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, সত্যিই তো মির্জা ফখরুল যে মন্তব্য করেছেন, তা অনেকাংশেই সঠিক ও বাস্তব। নিজের আড়াই দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকেই দেখলাম, আমাদের সাংবাদিকতা দলীয়করণ, কোটাকরণ ও নানা মেরুকরণে বিভক্ত। 

বাংলাদেশে হাজার হাজার সাংবাদিক, শত শত পত্রিকা, অনলাইন নিউজপোর্টাল, অর্ধশত টেলিভিশন আছে। কিন্তু কোথাও কি সুষ্ঠু সাংবাদিকতা হচ্ছে? নিরপেক্ষ সংবাদ বলতে যা বোঝানো হয়, সেটা কি হচ্ছে? সাংবাদিকতা কি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে? এমন নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব 'না' দিতে হবে।

কিন্তু কেন 'না' দিতে হলো? সেটাই কি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য থেকে ওঠে আসেনি? পৃথিবীর আর কোনো দেশে সাংবাদিকেরা এভাবে সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে জড়ান? 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের নিয়ে একটি কঠিন সত্য বলেছেন। তিনিও বলেছেন সাংবাদিকেরা যেন দলীয় রাজনীতিতে না জড়ান। অর্থাৎ রাজনীতিবিদেরাও চান সাংবাদিকেরা অন্তত নিরপেক্ষ থাকুক, যা ঘটনা তা প্রকাশ করুক। কিন্তু এ থেকে কি আমাদের সাংবাদিকেরা কোনো শিক্ষা নেবেন?  কিংবা অতীতে নিয়েছেন? 

অথচ বলা হয়, সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা। সাংবাদিকেরা হবেন সৎ সাহসী ও নিরপেক্ষ। গণতন্ত্রের তিনটি মূল স্তম্ভের কথা আমরা জানি। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা। কিন্তু চতুর্থ আরেকটি স্তম্ভ আছে, সেটা গণমাধ্যম। এই চারটি স্তম্ভের মধ্যে গণমাধ্যম এক বিশেষ কারণে আলাদা। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, কিন্তু অন্যান্য সকল ক্ষমতার উপর নজরদারি চালায়।

এই নজরদারি তখনই কার্যকর হয়, যখন সাংবাদিকতা থাকে নিরপেক্ষ, পেশাদার ও সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু সাংবাদিকেরা যখন দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন—সেই মুহূর্ত থেকেই সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই ভাঙন শুধু কোনো এক সাংবাদিকের পেশাগত ক্ষতি নয়; এটি গোটা সমাজ, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে।

একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত রাজনীতি, বিশ্বাস বা মতাদর্শ থাকতেই পারে, কিন্তু তা কখনোই সংবাদ পরিবেশনকে প্রভাবিত করতে পারে না। সমস্যা হয় তখনই, যখন সাংবাদিক সেই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাসকে দলীয় পরিচয়ে রূপ দেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ সাংবাদিকের পেশাদার পরিচয়কে প্রভাবিত করে, কারণ সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা মানে হচ্ছে—একটি দলীয় লক্ষ্য এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

মানুষ স্বভাবগতভাবে পক্ষপাতী; কিন্তু পেশাদার সাংবাদিকতা এই পক্ষপাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। সাংবাদিকের পরিচয় তখনই জটিল হয়, যখন তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের মিটিংয়ে যান, অংশ নেন, সিদ্ধান্ত নেন, বা প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। সেক্ষেত্রে তার সংবাদ—দল সমর্থিত নেতাদের ব্যর্থতা কম তুলে ধরে বিরোধী দলের ভুল বাড়িয়ে দেখায়, প্রাসঙ্গিক তথ্য বাদ দিতে শুরু করে, ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক বার্তা’ বানিয়ে ফেলে।

ফলে পাঠক আর তাকে সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং এক ধরনের দলীয় মুখপাত্র হিসেবে দেখতে শুরু করে। একটি নিউজরুম যদি রাজনীতি-সংক্রমিত হয়, সেটি আর সাংবাদিকদের পেশাদার কর্মক্ষেত্র থাকে না; হয়ে পড়ে ‘দলীয় মতের প্রতিযোগিতা’। এতে সংবাদ বাছাইয়ে পক্ষপাত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নির্দিষ্ট দলের নেতাদের প্রতি অতিরিক্ত অনুকম্পা দেখা যায়।

রিপোর্টারদের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি হয়। এই পরিবেশে নিরপেক্ষ সাংবাদিকেরা কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করেন; পেশাদারত্ব হারিয়ে যায়; প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়। দলীয় রাজনীতি একজন সাংবাদিকের সংবাদ লেখার ভাষায়ও প্রভাব ফেলে। সংবাদ ভাষায় কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে—সংক্ষেপ, নির্ভুলতা, যাচাইযোগ্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা। কিন্তু দলীয় পরিচয় যোগ হলে ভাষা হয়ে যায় আবেগপ্রবণ, প্রোপাগান্ডামূলক, পক্ষপাতপূর্ণ ও অর্ধসত্যভিত্তিক। 

একজন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সাংবাদিক লিখতে গিয়ে প্রায়ই তার নিজের মতামত বা মাইন্ডসেট থেকে বের হতে পারেন না।  এতে সাংবাদিকতা হারায় স্বতঃসিদ্ধ নিরপেক্ষতার সৌন্দর্য। রাজনৈতিক পরিচয় সাংবাদিককে হুমকিতে ফেলে। দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত সাংবাদিক রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। যা এখানে প্রায়ই দেখা যায়। 

দলীয় সাংবাদিক সত্য প্রকাশ করতে ভয় পান। নিজের দলের ভুল আড়াল করেন। সত্য প্রকাশের সাহস কমে যায়। কারণ, দল তাকে নীরব থাকতে বলতে পারে। দলীয় স্বার্থ সাংবাদিকের মূল্যবোধকে গ্রাস করতে পারে। গণমাধ্যম যদি দলীয় হয়ে যায়, তাহলে এটি আর জনগণের কণ্ঠস্বর থাকে না। এটি হয়ে দাঁড়ায় দলীয় প্রচারণার যন্ত্র। ফলে জনগণ সঠিক তথ্য পায় না, গণতন্ত্রে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়।

সরকারের ভুল চাপা পড়ে বিরোধীদের সমালোচনা অতিরঞ্জিত হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সুস্থ গণতন্ত্রে গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে এমন কি পৃথিবীর বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো সাংবাদিকদের দলীয় রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেখানকার সাংবাদিকেরা কোনো দলের, ব্যক্তির ক্যাম্পেইন বা দলীয় মন্তব্য করতে পারেন না। উন্নত দেশগুলো জানে, সাংবাদিক যদি দলীয় হয়, তাহলে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হতে পারে না।

আমাদের এখানে সাংবাদিকতার চেয়ে রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ দুটি কিন্তু ভিন্ন। সাংবাদিকতা পর্যবেক্ষণ করে, তথ্য দেয়, প্রশ্ন তোলে পাঠকের মত তৈরি করতে সাহায্য করে। আর অ্যাকটিভিজম অংশগ্রহণ করে, অবস্থান জানায়, নিজের মত চাপিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে এগিয়ে নেয়। একজন সাংবাদিক দলীয় রাজনীতিতে জড়ালে অ্যাকটিভিস্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

এতে তার সংবাদ হয় প্রভাবিত, নিরপেক্ষতার দাবি হয় দুর্বল। গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আস্থা। এই আস্থা একবার নষ্ট হলে পাঠক অন্যমুখী হয়ে যায়। যেভাবে মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে ঝুঁকছে। 

দলীয় সাংবাদিকতার কারণে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে, বিজ্ঞাপনদাতাদের আস্থা কমে, সাংবাদিকের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন সাংবাদিকের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ্যে এলে তার লেখা খবর পাঠক আর সহজভাবে বিশ্বাস করতে পারে না। আসলে সাংবাদিকতার মূল শক্তি হলো তার নিরপেক্ষতা।

এই নিরপেক্ষতা হারালে সংবাদ হারায় বিশ্বাসযোগ্যতা, সাংবাদিক হারায় শ্রদ্ধা, গণমাধ্যম হারায় সুনাম আর গণতন্ত্র হারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। একজন সাংবাদিক দলীয় রাজনীতি করতে পারেন, এটি তার নাগরিক অধিকার। কিন্তু দলীয় রাজনীতি করলে তিনি যে ‘সাংবাদিক পরিচয়’ বহন করেন, তার নৈতিক ভিত্তি ভেঙে যায়। তাই সাংবাদিকতার পবিত্রতা রক্ষা করতে হলে সাংবাদিকদের আগে নিজেদের দায়িত্ব বুঝতে হবে।

উপরের আলোচনা থেকে মনে হবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য নীতিকথা বলছি। কিন্তু এই নীতিকথাগুলোই সাংবাদিকতার জন্য সত্য এবং সত্য। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর চলে গেলো, এখনো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াতে পারল না। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকতা আরো চরম মাত্রায় দলীয়করণ হয়েছে, একপেশে হয়েছে। মিডিয়া হাউসগুলোতে পালাবদল হয়েছে দখলদারত্বের মাধ্যমে।

নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকতায় মব সংস্কৃতি চালু হয়েছে। একপাক্ষিক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এমন সাংবাদিকতা কয়েক দশকে বাংলাদেশ দেখেনি। কী পত্রিকা, কী টেলিভিশন- সব মাধ্যমে একই দৃশ্য। এ থেকে মুক্ত  হতে না পারলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অধরাই থেকে যাবে। সাংবাদিকতার মর্যাদা আর অবশিষ্টাংশটুকুও থাকবে না।

দেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বেরা বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। রাষ্ট্রের চতুর্থ ন্তম্ভকে এভাবে নিঃশেষ করে দিলে এখানে গণতন্ত্র কিংবা জবাবদিহি ব্যবস্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এমনিতেই রাষ্ট্রের মূল তিন স্তম্ভের অন্যতম আইনসভা পনেরো মাস ধরে বিলুপ্ত।

বিচার বিভাগেরও ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। নির্বাহী বিভাগ একচ্ছত্র দাপটে চলছে। অলিখিত চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়ায়ও যদি দলীয়করণ আর দখলীকরণে চলতে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না। ধন্যবাদ জানাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাংবাদিকদের চোখে আঙুল দিয়ে তাদের অবস্থানটি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

শংকর মৈত্র

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250