ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য হিসেবে উদার জ্ঞানতত্ত্বমূলক আখ্যানধর্মী প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশনা হলো কবিগান। কবিগানের দলনেতাকে কবিয়াল সরকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ধরনের পরিবেশনা দুটো দলের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পালার মধ্যদিয়ে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
কবিগানের উদ্ভব ও বিকাশ: কবিগান মধ্যযুগের শেষার্ধে আবির্ভূত হলেও আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে পল্লীবঙ্গে সাড়া ফেলতে শুরু করে। “কবিগানে স্থান দখল করতে সক্ষম হয় সমসাময়িক এবং প্রাচীন কালের সাংগীতিক ঐতিহ্যের শাখাসমূহ। এছাড়া কবিগান নাগরিক জীবন ও লোকজীবনেরই এক সম্মিলিত রূপ হিসেবে আবির্ভূত”।
কবিগান পরিবেশনের সময়: সাধারণত সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত কবিগানের আসর হয়ে থাকে। তবে শীতকালে কবি গানের আয়োজন দীর্ঘদিন যাবৎ হয়ে আসছে। এছাড়া, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক কবিগানের পরিবেশনা হয়ে থাকে।
কবিগানের আসর: কবিগানের পরিবেশনার জন্য বিশেষ কোনও মঞ্চের প্রয়োজন হয় না। খোলা জায়গা কিংবা বাড়ির উঠানেও কবিগানের পরিবেশনা হয়ে থাকে। দর্শকদের মাঝখানে কবিয়াল, দোহার ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী অবস্থান করে এর পরিবেশনা করে থাকে। তবে টিনের ছাউনি বা ছামিয়ানা টানার রীতি প্রচলিত।
কবিগানে আলোর ব্যবস্থা: কবিগানের পরিবেশনা সারারাত অবধি হয়ে থাকে বলে এর জন্য বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়। বিকল্প হিসেবে আজকাল জেনারেটর ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
সাজসজ্জা: কবিগানে কবিয়াল সরকার সাধারণত পাঞ্জাবি, পায়জামা বা লুঙ্গি পরিধান করে থাকেন। সাজসজ্জার কোনও আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না।
পোশাকের ব্যবহার: কবিগানের শিল্পীগণ বেশিরভাগ সময়ে প্যান্ট-শার্ট কিংবা ফতুয়া পরিধান করে গান পরিবেশন করে থাকেন। তবে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা বা ধূতি, লুঙ্গি, ফতুয়া ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার: কবিগান পরিবেশনার জন্য ঢোল, বাঁশি, হারমোনিয়াম, মন্দিরা, করতাল, জিপসী ও জরির ব্যবহার রয়েছে।
পরিবেশনা রীতি: কবিগানের ক্ষেত্রে দুটি ডাক বা বন্দনা শেষে কবিয়ালদ্বয় আসরে আসন গ্রহণ করেন। কবিগানে দুই পক্ষের কবিয়ালের মধ্যে মূল পর্ব শুরু করেন প্রথম পক্ষের কবিয়াল ও তার দুই সহযোগী টপ্পা পরিবেশনের মধ্যদিয়ে। টপ্পা পরিবেশনের পর কবিয়াল ‘পাড়ন’ শুরু করে দেন। আর ধুয়াগীতের মধ্যদিয়ে পাড়নের বিষয়কে নাটকীয় রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। এরপর পয়ার ছন্দ ছন্দ কথনের সমাপ্তির পর প্রথমপক্ষ বসে পড়েন। এবার প্রতিপক্ষের কবিয়াল নাটকীয় ভঙ্গিমায় প্রথম পক্ষের কবিয়ালের পাড়নের পত্যুত্তর করে একটি তত্ত্বমূলক গান পরিবেশন করেন। এবার প্রতিপক্ষের কবিয়াল প্রথম পক্ষের কবিয়ালের জন্য প্রশ্ন ছুড়েন। প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েই বসে পড়েন। “দুই কবিয়ালের নাটকীয় উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে ধরণ, পাড়ন, ফাড়ন, ফুকার, মিশ, মুখ, পেচ, খোচ, দ্বিতীয় ফুকার, দ্বিতীয় মিশ, মুখ, অন্তরা দ্বিতীয় চিতাল/পাড়ন, তৃতীয় ফুকার, তৃতীয় মিশ ইত্যাদি পথের ভেতর দিয়ে এক সময় কবিগান সমাপ্তির দিকে ধাবিত হয়ে থাকে”।
কবিগান ও কবিয়ালদের বর্তমান অবস্থা: বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু কবিয়াল এই ঐতিহ্যবাহী কবিগান গেয়ে বা পরিবেশন করে কবিগানের প্রচার এবং প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
তথ্যকণিকা
১. সাইমন জাকারিয়া, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও বৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৪৬৪-৪৬৬
২. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমি, ২০১৮
৩. এম এ মজিদ, যাত্রার ইতিবৃত্ত, কারুবাক, ঢাকা, ২০২০
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/