মঙ্গলবার, ২০শে মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য

সাংবাদিক-রাজনীতিবিদদের লড়াইয়ের অঙ্গীকারে সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১০:৩০ অপরাহ্ন, ৯ই মে ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে গত ৪ঠা মে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদের’ অনুষ্ঠানে 'মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য লড়াই চলবে' বলে সাংবাদিকদের পাশাপাশি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন রাজনীতিবিদরাও। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ডান ও বামপন্থী অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে বরেণ্য সাংবাদিক-সম্পাদকরা সেদিন অঙ্গীকার করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসের মধ্যে এমন ঘটনা এটিই প্রথম। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে সরকার? রাজনীতিবিদ-সাংবাদিকদের এ অঙ্গীকার গত প্রায় পাঁচদিনে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলেছে?

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে 'বিব্রতকর' প্রশ্ন করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসে অন্তত ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যা চেষ্টাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার 'রেকর্ড' প্রসঙ্গ গত রোববারের (৪ঠা মে) কয়েকটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ঘুরেফিরে আসে। গত ২৯শে এপ্রিল সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে অবমাননাকর’ প্রশ্ন করার অভিযোগে ঢাকার বেসরকারি তিনটি টিভি চ্যানেলের (দীপ্ত, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই) তিন সাংবাদিককে কর্তৃপক্ষের চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠে। বিষয়গুলোর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান সাংবাদিকরা।

সুখবর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার সরকারকে 'বিব্রতকর অবস্থার' মুখোমুখি করেছে। তবে বিষয়টিকে সরকার ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। সাংবাদিকদের অযথা হয়রানি করে, এমন বিষয়ে সরকার 'আরো সতর্ক' থাকবে। ২৬৬ সাংবাদিকের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো তদন্ত করবে আইন মন্ত্রণালয়। মিথ্যা মামলা বন্ধ করতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—সবকিছু একটি জায়গায় আনার চেষ্টা করছে সরকার। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ঢালাও মামলা যাচাই-বাছাইয়ে সাংবাদিক ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর এসব মামলার লিগ্যাল প্রসেসিং নিয়েও কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব মিথ্যা মামলায় কাউকে যেন গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা না হয়, সেই বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গত সপ্তাহে এসব বিষয়ে মৌখিকভাবে বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র সুখবরকে নিশ্চিত করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করেন, মামলা যে কেউ করতে পারেন। সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সরকার অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করছে কী না, সেখানে কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কী না—সেটা মূখ্য আলাপ-আলোচনার বিষয় হতে পারে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা ও মিথ্যা মামলা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠী ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে এসব মামলা করছে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের আউটরেজটা (ক্ষোভ) আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, আমরা পুরো বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সিস্টেম ঠিক করতে ব্যর্থ হয়েছি। যার বিরুদ্ধে সঠিক অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগে মামলা হয়নি। হয়েছে হত্যা মামলা। এটা নিয়ে আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি।’

সরকার লিখতে বাধা দিচ্ছে না, জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘মানুষ সবকিছু লিখতে পারছে। সরকার কাউকে লিখতে বাধা দিচ্ছে না। নেত্র নিউজে (কানাডা থেকে প্রচারিত) সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের (আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও দলটির নেতা) মেয়ে তার বাবাকে নির্দোষ দাবি করেন। সত্য হচ্ছে, আসাদুজ্জামান চারজন মানুষ হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িত। ২০১৩ বা ২০১৪ সালে তার গাড়িতে যারা হামলা করেছে, ওইখানে পাঁচজন লোককে গুম ও খুন করেছে। কিন্তু নেত্র নিউজে তার মেয়ের লেখা ছাপাতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।’

সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা আছে বলে জানান মাহফুজ। তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন তুলতে হবে। কিন্তু এটার ম্যাট্রিক্স কী, এটা কীভাবে কাজ করবে। জবাবদিহি করাটাই কি মুখ্য? নাকি আসলে আরও ১০টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এটা ভাবা দরকার। আমাদের সরকার প্রশ্ন নিতে রাজি আছে।’ মামলা-বাণিজ্য দেশের পুরোনো সংস্কৃতি উল্লেখ করে সব রাজনৈতিক দলকে এর থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তথ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘অজানা লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গায়েবি মামলা হলে ধরপাকড় চলতে থাকবে। শুধু সাংবাদিক নয়, আমি-আপনি এর শিকার হতে পারি। আমরা এর বিরুদ্ধে।’

তথ্য সচিব মাহবুবা ফারজানা সাংবাদিকদের জানান, ‘তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নির্দেশনায় সাংবাদিকদের মামলা-সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা হয়রানিমূলক কী না, সে বিষয়ে তথ্য চেয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বিএফইউজে, ডিইউজে, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পত্র দেওয়া হয়েছে। ‘

সচিব বলেন, ‘গত আট মাসে সংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া ২৬৬টি মামলা নিয়ে কাজ করছে সরকার। এর মধ্যে ৭৪টি মামলা হয়রানিমূলক, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগত কারণে নালিশি মামলা করা হয়েছে ২৯টি। সরকার চাইলেই এটা তুলতে পারবে না। চারটি মামলা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে, বাকিগুলো রাজনৈতিক মামলা।’

এদিকে ৪ঠা মে’র সম্পাদক পরিষদের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। 

সম্পাদকদের মধ্যে কথা বলেন সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি ও দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর, সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য রাখেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। 

এতে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিম ও দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন প্রমুখ।

এইচ.এস/

সাংবাদিকতা

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন